ঢাকা, রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

কীভাবে সামলে নেবেন তারেক রহমান?

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৪:২০ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩১ বার


কীভাবে সামলে নেবেন তারেক রহমান?

ঢাকা: জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়ছেন দেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গত ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন। দলের সূত্র ও চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা নয়, বরং এক জটিল সমীকরণের মধ্যে পড়ে গেছে।

একদিকে মায়ের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার জটিল কর্মযজ্ঞ, অন্যদিকে ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের টালমাটাল রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিশাল শূন্যতা- এই দ্বিমুখী চাপের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। হাজার মাইল দূরে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে থেকেও তিনি দলকে এতদিন সুতোয় গেঁথে রেখেছেন, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল ও দেশের এই ক্রান্তিকালে, আবেগের পাহাড়সম চাপ আর রাষ্ট্রনেতার গুরুদায়িত্ব- সব মিলিয়ে ইতিহাসের এই কঠিনতম সমীকরণটি কীভাবে সামলে নেবেন তারেক রহমান?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ৫ আগস্টের পর দেশে যে অস্থিরতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই সনদ, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে রেষারেষি সৃষ্টি হয়েছিল, সুস্থ থাকলে বেগম খালেদা জিয়া তার এক আহ্বানেই তা অনেকটা প্রশমিত করতে পারতেন। ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রধান প্রতীক ছিলেন তিনি। তার ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের মা’ ভাবমূর্তি এখন আর কেবল দলীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। আওয়ামী লীগ পরবর্তী এই সময়ে ডান-বাম, ইসলামপন্থী কিংবা উদারপন্থী- সব মতের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র।

বিপ্লব পরবর্তী সময়ে একটি দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এমন একজন নেতার প্রয়োজন হয়, যার কথা সবাই মান্য করবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকলেও, রাজনৈতিক মাঠের নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকে। রাজনীতি সংশ্লিষ্ঠরা মনে করছেন, দেশের সংকটে যদি খালেদা জিয়া সুস্থ অবস্থায় গুলশান কার্যালয়ে বসে একটি দিকনির্দেশনা দিতেন, তবে দল-মত নির্বিশেষে সবাই সেটা মেনে নিতো। তার ত্যাগের ইতিহাস নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে কারোই কোনো দ্বিমত নেই। এই নৈতিক কর্তৃত্বের অভাবটি এখন হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।

এই শূন্যতার মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে- মা বেগম খালেদা জিয়া যে ঐক্যের প্রতীক হতে পারতেন, তারেক রহমান কি সেই জায়গাটি পূরণ করতে পারবেন? রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মতে, লন্ডন থেকে দেওয়া তারক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে তিনি সেই রাষ্ট্রনায়কোচিত উদারতা দেখানোর চেষ্টা করছেন, যা জাতি বেগম জিয়ার কাছে প্রত্যাশা করে।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশের প্রেক্ষাপট ছিল ট্র্যাজিক এবং কিছুটা আকস্মিকও। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি যখন অস্তিত্ব সংকটে; দলে ভাঙনের সুর বাজছে, ঠিক তখনই দলের হাল ধরতে ডাক পড়ে এক সাধারণ গৃহবধূ, দুই সন্তানের জননী বেগম খালেদা জিয়ার। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। এর দুই বছর পর, ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। তার এই যাত্রাপথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ।

সেদিনের সেই স্বল্পভাষী, লাজুক গৃহবধূটি যে একদিন বাংলাদেশের রাজনীতির ‘লৌহমানবী’তে পরিণত হবেন, তা হয়তো অতি বড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকও তখন ধারণা করতে পারেননি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি সেসময় রাজপথে নেমে এসে স্লোগান ধরেন এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করেন। ওই সময়ে অনেক বাঘা বাঘা নেতা এরশাদ সরকারের সাথে আপস করলেও খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়। এই অনমনীয় মনোভাবই তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ এবং পরবর্তীতে ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।

বেগম খালেদা জিয়া এ দেশে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন (১৯৯১, ১৯৯৬ সালের স্বল্পকালীন এবং ২০০১)। তবে ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন তার ভূমিকা ছিল আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ১/১১-এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার (মাইনাস টু ফর্মুলা) সব আয়োজন সম্পন্ন হলেও তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এই দেশই আমার সব।” তার এই দেশপ্রেম তাকে সাধারণ মানুষের আরও কাছে নিয়ে যায়।

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার ওপর যে পরিমাণ জুলুম, নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা অবর্ণনীয়। ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে বছরের পর বছর তিনি বন্দি জীবন কাটিয়েছেন, তবুও সরকারের কাছে মাথা নত করেননি বা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশ চলে যাননি। জীবনসায়াহ্নে এসেও তাই তিনি দলের ঐক্যের প্রতীক হয়ে আছেন।

বেগম খালেদা জিয়ার এই বিশাল রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এখন বর্তাচ্ছে জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের কাঁধে। কিন্তু তারেক রহমানের পথচলাটা মায়ের মতো মসৃণ ছিল না, ছিল বিতর্কিত। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে রাজনীতিতে তারেক রহমানের সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধস বিজয়ের পেছনে তার তৃণমূল গোছানোর কৌশলের বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন দলের নেতা-কর্মীরা। তবে ২০০১-২০০৬ শাসনামলে ‘হাওয়া ভবন’ কেন্দ্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বড় দাগ ফেলে দেয়। সে সময় তিনি বনানীর হাওয়া ভবনে বসে সমান্তরাল প্রশাসন চালাতেন বলে অভিযোগ ছিল বিরোধীদের।

২০০৭ সালে ১/১১-এর পটপরিবর্তনের পর তারেক রহমান গ্রেফতার হন। রিমান্ডে তার ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায় বলেও অভিযোগ করা হয় দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে। ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান এবং সেই থেকে গত ১৭ বছর তিনি নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।

লন্ডনে থাকাকালীন সময়টা তারেক রহমানের জন্য ছিল নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সময়। শুরুতে তিনি চুপচাপ থাকলেও ধীরে ধীরে দলের হাল ধরেন। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় এবং পরবর্তীতে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে তিনি স্কাইপ ও জুমের মাধ্যমে দলের নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, “২০০১ সালের তারেক রহমান আর ২০২৪ সালের তারেক রহমানের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। গত ১৭ বছরে তিনি অনেক পরিপক্ক হয়েছেন। লন্ডনে বসে তিনি উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার চর্চা দেখেছেন। পড়াশোনাও করেছেন। দলের প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করে তিনি দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ম্যাডাম (বেগম খালেদা জিয়া) জেলে থাকার সময় অনেকে ভেবেছিল বিএনপি ভেঙে যাবে, কিন্তু তারেক রহমান সুতোয় গাঁথা মালার মতো দলকে এক করে রেখেছিলেন।”

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বক্তব্যের ধরন শুধু নিজের দলের নেতাকর্মীদেরই নয়, বরং বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষসহ সবাইকে বেশ অবাক করেছে। তিনি প্রতিশোধের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে এক ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশের ডাক দিয়েছেন।

সরকার পতনের পরপরই এক ভিডিও বার্তায় তারেক রহমান নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বিজয়ীর কাছে পরাজিতরা নিরাপদ থাকলে বিজয়ের আনন্দ মহিমান্বিত হয়। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত শান্তভাবে উদযাপন করুন। অনুগ্রহ করে কেউ প্রতিরোধ প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না। কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিবেন না। অর্জিত বিজয় যাতে লক্ষ্যচ্যুত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক এবং সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য আপনাদের প্রতি আহ্বান।” তিনি আরও বলেন, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যাতে কোনো হামলা না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখবেন, তারা আমাদের ভাই, আমাদের প্রতিবেশী। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর তারেক রহমানের এসব বক্তব্য তাকে ‘দলের নেতা’ থেকে ‘জাতীয় নেতা' হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছে। তিনি যখন বলেন, “দেশটা কারো একার নয়, সবার। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার থাকবে,” অথবা "সবার আগে বাংলাদেশ", তখন তার মধ্যে তার বাবা জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিধ্বনি শোনা যায় বলে মনে করেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া কর্মীদের কাছে ‘মা’ এর মতো। তার প্রতি কর্মীদের যে নিঃশর্ত ভালোবাসা ও আবেগ, তা দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফসল। তারেক রহমান কর্মীদের কাছে ‘ভাইয়া’ বা ‘নেতা’। মায়ের প্রতি যে আবেগ, তা ছেলের প্রতি শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হতে সময় লাগবে। তবে তারেক রহমান গত এক দশকে কর্মীদের সাথে যে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছেন, তাতে সেই দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে বলে তারা মনে করেন।

এছাড়া খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ছিল অনেকটা সহজাত ও ক্যারিশম্যাটিক। তিনি রাস্তায় নামলেই মানুষ জড়ো হতো। অন্যদিকে তারেক রহমানের নেতৃত্ব অনেকটা কৌশলী ও সাংগঠনিক। তিনি তথ্য-উপাত্ত নির্ভর রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দলকে তিনি কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করেছেন, যা আধুনিক রাজনীতির জন্য অপরিহার্য। খালেদা জিয়া দলমত নির্বিশেষে অনেকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন তার আপসহীনতার কারণে। তারেক রহমানকে এখনো ‘হাওয়া ভবন দুর্নীতি’, বা ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা’র মতো অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যদিও ৫ আগস্টের পর সেই বয়ান অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে, তবুও সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা তার জন্য এখনো বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে বর্তমানে এক বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। শেখ হাসিনার পলায়নের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য ও ছন্নছাড়া। অন্যদিকে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। এই পরিস্থিতিতে দেশে ‘জাতীয় নেতা’ হয়ে ওঠার মতো সামর্থ্য ও জনসমর্থন এই মুহূর্তে একমাত্র তারেক রহমানেরই রয়েছে বলে মনে করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা নেতাদের নিজেদের প্রমাণ করতে হয়। ভারতের রাহুল গান্ধী, পাকিস্তানের বিলাওয়াল ভুট্টো কিংবা বেনজির ভুট্টো- সবাইকেই তাদের পূর্বসূরিদের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে লড়াই করতে হয়েছে। তারেক রহমানকেও সেই লড়াইটা করতে হচ্ছে। তবে বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তার জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তিনি যদি আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন এবং দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তবে তিনি খালেদা জিয়ার অভাব পূরণ করতে পারবেন তারা মনে করেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের আবেগ, আমাদের অস্তিত্ব। তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যৎ। তিনি যেভাবে ১৭ বছর ধরে দলকে আগলে রেখেছেন, তাতে আমরা বিশ্বাস করি তিনি দেশ পরিচালনার জন্য পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত। তিনি এখন আর শুধু বিএনপির নেতা নন, ১৭ কোটি মানুষের মুক্তির দিশারী। এ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার তার হাত ধরেই ঘটবে।’ 

তবে তৃণমূলের অনেক কর্মী মনে করেন, তারেক রহমানকে দেশে এসে সরাসরি জনগণের সাথে মিশতে হবে। জুম বা স্কাইপের মাধ্যমে দল চালানো আর দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে জনসভা করার মধ্যে পার্থক্য আছে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাদের নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে এক বিস্ময়কর ধারা লক্ষ্য করা যায়। যখনই এই দেশ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, গণতন্ত্র পথ হারিয়েছে কিংবা রাষ্ট্র নেতৃত্বশূন্য হয়েছে, ঠিক তখনই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে জিয়া পরিবার। এটি কি নিছক কাকতালীয়, নাকি ইতিহাসের অনিবার্য লিখন? এই প্রশ্ন এখন জোরালোভাবে সামনে আসছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনা এবং ৩ নভেম্বরের খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ যখন চরম অনিশ্চয়তায়, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল, সিপাহী-জনতা তখন বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এনেছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। ৭ নভেম্বরের সেই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান শক্ত হাতে দেশের হাল ধরেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন এবং তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দাঁড় করান।

এরপর আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনামলে গণতন্ত্র যখন নির্বাসিত, তখন গৃহবধূ থেকে রাজপথে নেমে আসেন খালেদা জিয়া। আপসহীন আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে তিনি স্বৈরাচারের পতন ঘটান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। অর্থাৎ দ্বিতীয়বারের মতো জাতি যখন পথ হারিয়েছিল, তখন জিয়া পরিবারের আরেক সদস্যই জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলেন।

২০২৬-এর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আবারও দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শূন্যতা বিরাজমান। পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাত ভঙ্গুর। এই পরিস্থিতিতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কি বজায় থাকবে? ১৯৭৫-এ জিয়াউর রহমান এবং ১৯৯০-এ খালেদা জিয়ার পর, ২০২৪-এ কি তারেক রহমান সেই ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইতিহাস প্রমাণ করে, এই দেশের মাটি ও মানুষ জিয়া পরিবারের ওপর আস্থা রাখে। যখনই ক্রান্তিকাল এসেছে, এই পরিবারই বুক পেতে দিয়েছে। তারেক রহমান এখন সেই ইতিহাসের দায়বদ্ধতা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি যেভাবে নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন এবং ৩১ দফার মাধ্যমে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা দিয়েছেন, তা প্রমাণ করে তিনি তার বাবা ও মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত। তিনি এখন আর দলের নেতাই নন, দেশের নেতা।’

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৭৫ বা ১৯৯০-এর পরিস্থিতি আর ২০২৫-এর বাস্তবতা এক নয়। এখনকার ভূ-রাজনীতি, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব এবং তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন। তারেক রহমানকে তার বাবা-মায়ের ঐতিহ্য বহন করার পাশাপাশি ‘জেন-জি’ বা নতুন প্রজন্মের ভাষাও বুঝতে হবে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন। যদিও এই মুহূর্তে মায়ের চিকিৎসা নিয়েই তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবতে হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো শিগগিরই তিনি দেশের পথে রওনা হবেন বলে মনে করছেন দলের শীর্ষ নেতারা। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ফিরে এসে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তিনি যদি সব বিভেদ ভুলে জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারেন, তবেই তিনি প্রমাণ করতে পারবেন- সংকটে জিয়া পরিবারই বাংলাদেশের অনিবার্য গন্তব্য।

বেগম খালেদা জিয়া এখন এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সময় কাটাচ্ছেন। কখন এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসবে, কখন তিনি লন্ডনে যাত্রা শুরু করবেন- তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে এসব ধোঁয়াশা কাটছে না। কিন্তু রাজনীতির নির্মম সত্য হলো, সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নেতৃত্বের মশাল এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তরিত হওয়াই প্রকৃতির নিয়ম।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমান তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন জাতীয়তাবাদের দর্শন, আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন আপসহীনতার শিক্ষা। গত ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন তাকে শিখিয়েছে ধৈর্যের গুরুত্ব। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তার পরিপক্ক আচরণ ও বক্তব্য তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি যদি দেশের এই গভীর রাজনৈতিক সংকটে ‘জাতীয় নেতা’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তবে তা হবে ইতিহাসের এক অনন্য পুনরাবৃত্তি।


   আরও সংবাদ