ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:১১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৭ বার
ঢাকা: কঠিন রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে দলটি তাদের মাঠের রাজনীতিতে সহসা সক্রিয় হতে পারবে কিনা, সেটি বড় প্রশ্ন।
বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনাও চলছে।
সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে। সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার ফেরা ‘অত্যন্ত কঠিন’ হয়ে পড়বে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে সেদিনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। বর্তমানে সেখানেই তিনি কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে অবস্থান করছেন।
শেখ হাসিনা পালানোর পাশাপাশি তার দলের নেতাকর্মীরাও ৫ আগস্ট আত্মগোপনে যান। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কেউ কেউ সেদিন, আবার কেউ কেউ আগে-পরে বিদেশে চলে যান। প্রায় চার মাস হতে চললো আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ কত দিনে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াবে বা আদৌ পারবে কিনা, সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে। তা ড়া দলের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। তার ফেরার সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতের ওপর, এমনটা মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
যদিও ভারতে বসে শেখ হাসিনা তার দলের কতিপয় নেতা-কর্মীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন বলে জানা গেছে। এমন কয়েকটি কথিত ‘ফোনালাপ’ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে শেখ হাসিনাকে বেশ আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে শোনা যায়। অবশ্য এসব ফোনালাপের সত্যতা নিয়েও নানা প্রশ্ন-বিতর্ক আছে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩০০ মামলা হয়েছে। বেশিরভাগই হত্যা মামলা। এর মধ্যে গণহত্যার বেশ কিছু অভিযোগও পড়েছে হাসিনার নিজের গড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। দেশের মানুষের মধ্যেও শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতা-কর্মীদের ওপর তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধেরও দাবি উঠেছে। সার্বিক বিবেচনায়, আওয়ামী লীগ ও নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার শেখ হাসিনার জন্য প্রায় অসম্ভব। যদি সম্ভবও হয়, সেটা সময়ের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
পাশাপাশি শেখ হাসিনার বয়সও আলোচনায় রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বছরে তার বয়স ৭৭ বছর। দিন যত গড়াবে তার নিজের শারীরিক সুস্থতা ধরে রাখাও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে হাসিনার জন্য।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, এই কাজটা শুধু কঠিন নয়– খুবই কঠিন! এখনো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সে দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে, তাদের দলীয় সংগঠনও ছত্রভঙ্গ! শেখ হাসিনার বয়স আজকের চেয়ে দশটা বছর কম হলে তবু হয়তো মনে করা যেত তিনি দেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন– কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতিতে পুনর্বাসন বা হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধার করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সব চেয়ে বড় শক্তি দেশের জনগণ। শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে, দেশে ফিরে আসতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জনগণের আস্থা অর্জন, জনগণের সমর্থন। আর এটা করতে বড় ভূমিকা থাকতে হবে নিজ দল আওয়ামী লীগের।
অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা বা তার দলের কোনো নেতা-কর্মীর জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ করেননি। বরং ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ধরে উল্টো অনলাইনে-অফলাইনে আন্দোলনকারীদের ‘দেখে নেওয়ার হুমকি’ ছাত্র-জনতার ক্ষোভকে আরও উসকে দিচ্ছে। সে হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করা তাদের জন্য কতটুকু সহজ হবে, তা বলা সময়সাপেক্ষ।
কারণ এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার বিচারের দাবি তোলা হয়েছে। একইসঙ্গে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বিচার ছাড়া তাদের রাজনীতি পুনর্বাসনচেষ্টার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
গত ২০ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশে থাকা সমর্থকদের সরকারবিরোধী আন্দোলন করার জন্য উস্কানি দিচ্ছে। আমি তাদের বলতে চাই শেখ হাসিনা বাংলাদেশে রাজনীতি করার জন্য আর ফিরতে পারবে না। শুধুমাত্র ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়ানোর জন্যই ফিরবে। ’
গত ৫ নভেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিষয়ে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার মহাবিপ্লবের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছি। হাসিনাসহ অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের দোসর-প্রেতাত্মারা এখনো সর্বত্র বসে আছে। তারা প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। মনে রাখতে হবে এসব পতিত স্বৈরাচারের দোসররা সময় সুযোগ বুঝে ফের জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানে দেখা দরকার, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা দৃঢ়। আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে যদি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারে, তাহলে পুরো বিষয়টি সেটির ওপর নির্ভর করবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে, এমনটাই দেখা গেছে। কেউ কি ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার আসতে পারবে? তাই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা এখনই বলা কঠিন। তিনি যদি রাজনীতি থাকেন, সেটি নির্ভর করবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর, তার দলের ওপর। দল কতটুকু জনগণকে কাছে টানতে পারবে সেটি বড় প্রশ্ন। ’
বিশ্বের পলাতক স্বৈরশাসকরা ফিরতে পারেননি
আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বহু স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বাংলাদেশের আগে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় শ্রীলঙ্কায়। দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে গণঅভ্যুত্থানের কারণে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি স্বৈরশাসক ছিলেন, মোটা দাগে বলা যাবে না। কিন্তু তার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি গোটা লঙ্কায় ভারী হয়ে উঠেছিল।
দুই বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া রাজাপাকসে পরিবার ফের শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ফিরে আসছে। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির বৃহত্তম রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরুমনার (এসএলপিপি) প্রার্থী হচ্ছেন নামাল রাজাপাকসে। তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে। মাহিন্দা একসময় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টও ছিলেন।
বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। স্বৈরাচার গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। তার ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় এমন খবর প্রকাশ হয়েছে।
মিশরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ছেলে গামাল মোবারকও রাজনীতিতে ফিরতে পারেন। মিশরীয়রা তাকে দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়।
১৯৯৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। তার ক্ষমতাচ্যুতির পরে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। ১৬ বছর পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার মেয়ে সিতি হেদাইতি সুহার্তো নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করেন। আর এ বছরের নির্বাচনে সুহার্তোর জামাতা প্রাবোও সুবিয়ান্তো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গত অক্টোবরে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
২০০৬ সালে একটি টেলিকম কোম্পানি বিক্রয়কে কেন্দ্র করে থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই বছরেই থাইল্যান্ডের থাকসিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির সেনাবাহিনী। তাকে ও তার দলকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় থাইল্যান্ডে। পরবর্তীতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন থাকসিনের মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা।
এসব ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব দেশে স্বৈরশাসকের জন্ম হয়েছিল, তার পতনও হয়েছে। অনেকে ফিরে আসতে না পারলেও তাদের পরিবারের কেউ না কেউ রাজনীতিতে এসেছেন।
শেখ হাসিনার ছেলে জয় যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। মেয়ে পুতুল রাজনীতি করেন না। হাসিনার বোন শেখ রেহানা রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন। তার মেয়ে টিউলিপ যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য। ছেলে ববি যুক্তরাজ্যে জন্ম নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজে যুক্ত। তবে তাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যায়নি। রেহানার ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী লন্ডনে ‘কন্ট্রোল রিস্কস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার বেলায় কী হয়, সেটি ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে মনে করেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।