ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ফাঁকি দিচ্ছে প্রত্যেকেই প্রতিদিন কয়েক হাজার কোটি টাকার

নিজস্ব প্রতিবেদক


প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৬১৮ বার


ফাঁকি দিচ্ছে প্রত্যেকেই প্রতিদিন কয়েক হাজার কোটি টাকার

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) কয়েক বছর আগের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ছোটবড় দোকান আছে ৫৬ লাখের বেশি। গত চার-পাঁচ বছরে কী পরিমাণ দোকান বেড়েছে তার প্রকৃত পরিসংখ্যান নেই। তবে দোকান মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, মহানগরগুলোতে অন্তত দুই কোটি পরিবার এখন দোকানের ওপর নির্ভরশীল। সেই হিসাবে দোকান মালিক আছেন ৭০ লাখেরও বেশি।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শহরের সব দোকান মালিকদের যদি ভ্যাট নিবন্ধন নিশ্চিত করে ইলেকট্রনিক ফিসকেল ডিভাইস (ইএফডি) দেওয়া হতো, তবে সরকার অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব বেশি পাবে। ইউনিয়ন বা গ্রামপর্যায়ে মেশিন দেওয়া সম্ভব হলে বছরে ৫ লাখ কোটি টাকাও ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হতো।’

 

তার মতে, ‘কোনও দোকান মালিক চুলচেরা ভ্যাট দিচ্ছে না। এমনকি রিটার্নও জমা দিচ্ছে না অনেকে। আগে প্যাকেজ ভ্যাটের আওতায় সরকার তাদের কাছ থেকে কিছু রাজস্ব পেতো। এখন সেটাও পাচ্ছে না।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট গোয়েন্দাদের এক জরিপে দেখা গেছে, যারা দিনে লাখ টাকার বেশি লেনদেন করছে তাদের প্রতি পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিরই বিআইএন বা ভ্যাট নিবন্ধন নেই। ২৪ থেকে ৩১ মে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর নামকরা ১৭টি বিপণিবিতানে এ জরিপ চালায় ভ্যাট গোয়েন্দাদের চারটি দল।

এনবিআর সূত্র জানায়, দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র আট লাখ। এদের মধ্যে অনলাইনে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে ৯৬ হাজার প্রতিষ্ঠান। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করে ২০-২২ হাজার প্রতিষ্ঠান। ৬৫ থেকে ৬৮ লাখ দোকান মালিক বছরের পর বছর ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন।

যাদের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার কম, তাদের ভ্যাট দিতে হবে না। অর্থাৎ গড়ে দিনে ১৪ হাজার টাকার বেশি লেনদেন হলেই ভ্যাট দিতে হবে।

মূলত ভ্যাট যোগ করেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। ক্রেতা পণ্য কিনতে গিয়ে নিজের অজান্তে ভ্যাটও পরিশোধ করেন। কিন্তু সরকারি কোষাগারে তা জমা না দিয়ে ব্যবসায়ীরা ঢোকান নিজের পকেটে।

জানা গেছে, রাজধানী ছাড়াও অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা, ও উপজেলা শহরের প্রায় শতভাগ দোকানে দিনে গড়ে লেনদেন হয় ২০ হাজার টাকার বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রধান শহরগুলোর অধিকাংশ দোকানে দিনে ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকার উপরেও লেনদেন হয়। অথচ সরকার এ খাত থেকে রাজস্ব পাচ্ছে না। জানা গেছে, দিনে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা লেনদেন হয় এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আছে কয়েক হাজার। তারাও ভ্যাট দেয় না।

কত টাকার রাজস্ব পাওয়া সম্ভব?

প্রত্যেক ব্যবসায়ী (৭০ লাখ) যদি মাসে গড়ে ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট দেয় তা হলে দোকান মালিকদের কাছ থেকে মাসে দশ হাজার পাঁচ শ’ টাকা পাবে সরকার। বছরে পাবে এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর বড় বড় দোকানির বড় ভ্যাট মিলিয়ে নিলে সংখ্যাটা আরও কয়েক লক্ষ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা হয়।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনও মনে করেন দোকান মালিকদের একটি বড় অংশ সরকারকে ভ্যাট দেয় না। তিনি বলেন, ‘দোকানিরা ভ্যাট নিবন্ধন নিতে চায়। হিসাব-নিকাশ রাখার জন্য ইএফডি দেওয়া হলে সবাই ভ্যাট দেবো। তখন ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না।’

ফাঁকি দিচ্ছে প্রত্যেকেই

এনবিআরের ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের নামে ভ্যাট নিবন্ধন নেই।

গত মে’র শেষের দিকে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে ১০২৪টি দোকানে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, মাত্র ১২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন আছে। সেসব ব্যবসায়ীর দেওয়া ভ্যাটও বাস্তবতার সঙ্গে ‘সঙ্গতিপূর্ণ নয়’। অর্থাৎ প্রায় শতভাগ দোকান মালিক কোনও না কোনোভাবে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েই যাচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, মে মাসেই ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতরের তিনটি দলের ৪২ জন গোয়েন্দা আটটি মার্কেটে জরিপ চালিয়েছেন।

জরিপে দেখা গেছে, বিপণিবিতানগুলোর ২ হাজার ১৩৩টি দোকানের মধ্যে ১ হাজার ৬৫১টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে অনেক দোকানি ১০ বছরেরও বেশি সময় ব্যবসা করছেন ভ্যাট দেওয়া ছাড়া। ৮৮ শতাংশ দোকান ভ্যাটের আওতায়ই আসেনি।

জরিপে যে ১২০টি দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন পাওয়া গেছে, তার মধ্যে মাত্র ৪৫টি দোকান মালিক মাসে ৫ হাজার টাকার বেশি ভ্যাট দেয়। বাকি ৭৫টি দোকান ভ্যাট দেয় এর কম। যা তাদের দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খরচ এবং মুনাফার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করছে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

জরিপে বলা হয়েছে, যে ৪৮২টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন আছে, তাদের মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন দেয় ৪৪৫টি। তাদের মধ্যে মাসে পাঁচ হাজার টাকার বেশি ভ্যাট দেয়, এমন প্রতিষ্ঠান মাত্র ১১৩টি।

এ প্রসঙ্গে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারকে ভ্যাট দেওয়ার ক্ষেত্রে দোকান মালিকদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীদের অনীহা বেশি।’

উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকে পরোক্ষ কর ভ্যাট ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। রাজস্ব আদায়ের এই পদ্ধতি বাতিলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামলেও তৎকালীন সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে এই পদ্ধতি কঠোরভাবে প্রণয়ন করে।

মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতেই বড় বড় দোকান ব্যবসায়ী আছেন ৬ থেকে ৭ লাখ। যাদের অধিকাংশেরই দিনে লেনদেন লাখ টাকার বেশি।

খুলনায় আছে দুই লাখের মতো বড় দোকান মালিক। দিনে লাখ টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয় তাদের। একইভাবে রাজশাহীতে এক লাখ, চট্টগ্রামে চার লাখ। এ ছাড়া জেলা শহরগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার দোকান ব্যবসায়ী আছেন। কোনও উপজেলায় দোকান ব্যবসায়ী রয়েছেন এক হাজার থেকে ১০ হাজার।


   আরও সংবাদ