ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

বিশ্ব অর্থনীতিতে আবারো ধাক্কা 

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:১১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৫৭ বার


বিশ্ব অর্থনীতিতে আবারো ধাক্কা 

মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছিল তার রেশ মাঝখানে কিছুটা কাটতে শুরু করে। 

মাঝপথে দেশগুলো তাদের আমদানি-রপ্তানি এবং অন্যান্য বাণিজ্য সচল করতে সবকিছু খুলে দেয়। এতে কর্মীরা হারানো চাকরি ফিরে পাওয়াসহ অর্থনীতির নানা খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফিরে আসে। কিন্তু করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন এই হিসাব সবকিছুই উলটে-পালটে দিচ্ছে।

দুনিয়া জুড়ে শেয়ারবাজার ক্রমাগত পড়ছে। অর্থনীতির মূল নিয়ামক জ্বালানি তেলের দামও পড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। করোনার নতুন ধরন থেকে বাঁচতে ইউরোপের অনেক দেশ জনচলাচল নিয়ন্ত্রণসহ লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। অনেক জায়গায় রেস্টুরেন্ট এবং খুচরা বিক্রি প্রায় বন্ধ। তবে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে এর প্রভাব খুব সামান্যই পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। যদিও করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য এবং রেমিটেন্সে (প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ) ইতিমধ্যে গতির সঞ্চার হয়েছে। এখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মূল শঙ্কা কাঁচামাল এবং আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যয় নিয়ে।

আশা যখন হতাশায় পরিণত হয়
পশ্চিমা বিশ্বে ক্রিসমাস বা বড়দিনের উত্সব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনিয়োগকারীরা আশা করেছিলেন, বড়দিনের এই উত্সবে তাদের ব্যবসার ক্রমাগত উন্নতি হবে। কিন্তু তাদের এই আশা সফল তো হচ্ছেই না, বরং অর্থনীতি আরো দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে বিশ্বের অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী দেশগুলোতে শেয়ারবাজারের পতন হয়েছে এবং তেলের দামও পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে স্হানীয় সময় সোমবার সকালে দরপতন হয় ৪০০ পয়েন্ট বা এক শতাংশ কমে যায়। গত শুক্রবার মার্কিন শেয়ারবাজারে গত তিন সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় দরপতন হয়। ৫৩২ পয়েন্ট বা এক দশমিক ৫ শতাংশ কমে যায়। অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৩ শতাংশ কমে ৭১ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের বড় বড় শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে প্রায় এক শতাংশ। এশিয়ার বেশির ভাগ শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে, কেবল ব্যতিক্রম সাংহাই শেয়ারবাজার। চীনের সুদের হার কমিয়ে দেওয়ায় এই বাজার বরং আগের চেয়ে ভালো করেছে। 

হিসাব পালটে দিচ্ছে ওমিক্রন
বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করা করোনা ভাইরাস লাখ লাখ মানুষকে পথে বসিয়েছিল। কিন্তু লকডাউনসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর আবার মানুষের আর্থিক অবস্হার উন্নতি হতে শুরু করেছিল। নতুন করেই সেই উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে ওমিক্রম নামে করোনার নতুন ধরন। বিশ্বের অন্তত ৮৯টি দেশে এই ধরন ছড়িয়ে পড়েছে যা এর আগে করোনার ডেলটার ধরনের চেয়েও মারাত্মক বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। 

বিশ্বের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে ওমিক্রন ছড়াচ্ছে বিদু্যতের গতিতে। যে সময় পশ্চিমা বিশ্বে মানুষ ছুটি কাটাতে যায় এবং অর্থনীতি শক্তিশালী হয় সেই সময়ে লকডাউনসহ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য করছে ওমিক্রন। ফলে মানুষ বাইরে বের হতে না পারায় প্রভাব ফেলছে অর্থনীতিতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি বাধা হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বড় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এক দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ বিলটি পাশ না হওয়া। ইতিমধ্যে ডেমোক্র্যাট সিনেটর জো মানচিন এই বিলের বিরোধিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। ওমিক্রন শঙ্কাটা এমন পরিমাণে বাড়িয়েছে যে, নিউ ইয়র্কভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান সাকস্ যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রথম প্রান্িতকে ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে দুই শতাংশ নির্ধারণ করেছে। কারণ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৪৫টি রাজ্যে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। গত রবিবার তৃতীয় দিনের মতো নিউ ইয়র্কে ওমিক্রনের সংক্রমণ রেকর্ড গড়েছে। ইউরোপে প্রায় ৯ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে প্রায় ১৫ লাখ। 

যুক্তরাজ্যে শনিবার পর্যন্ত ২৫ হাজারের বেশি মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে। এক দিনেই ৯০ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। নেদারল্যান্ডসে ইতিমধ্যে লকডাউন জারি করা হয়েছে। আয়ারল্যান্ড এবং জার্মানিতেও কিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। জার্মানিভিত্তিক বেরেনবার্গ ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হোলগার শ্মাইডিং গতকাল সোমবার জানিয়েছেন, করোনার বুস্টার ডোজ হয়তো চিকিত্সার ঝঁুকি কিছুটা কমাতে পারে, কিন্তু ওমিক্রন যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে বিধিনিষেধ জারি ছাড়া সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই অর্থনীতি ধ্বংসকারী কিছু পদক্ষেপ না নিয়ে কোনো উপায় থাকবে না দেশগুলোর। এর প্রমাণ নেদারল্যান্ডস যেখানে লকডাউন জারি করা হয়েছে। এর ফলে ২০২২২ সালের প্রথম প্রান্িতকে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে অর্থনীতির এক শতাংশের পতন হবে। ওমিক্রন এতটাই আতঙ্ক ছড়িয়েছে যে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের দাভোস সম্মেলনও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

আগামী ১৭-২১ জানুয়ারি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ওমিক্রনের প্রভাব সঠিকভাবে যাচাই না করে এই সম্মেলন আয়োজন করা ঠিক হবে না। কারণ এই মুহূর্তে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা খুবই কঠিন হবে। গত ৩০ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্হার মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন কথা ছিল। কিন্তু ওমিক্রনের দৌরাত্মে্যর কারণে তা স্হগিত করা হয়। ফলে বাতিল হয় অসংখ্যা টিকিট ও ফ্লাইট। প্রবল এক ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসা পরিবহন খাত আবারও ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বের পর্যটন খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মহামারির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গমের উত্পাদন বিশ্বে এক বছরে কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে গত এক বছরে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। কানাডা, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহত্ রপ্তানিকারক দেশগুলোয় গমের ফলন কমায় তারা রপ্তানিতে লাগাম টেনেছে। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দামও হুহু করে বাড়ছে। 

খাদ্যশস্য হিসেবে গম থেকেই প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে নানা রকমের প্রধান খাদ্য প্রস্ত্তত করা হয় বিশ্ব জুড়ে। এ ছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হা বলছে, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা বিধিনিষেধের অর্থ, অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব। ২০২২ সালে কি তেমন পরিস্হিতি আবার ফিরে আসবে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়বে? গবেষণা সংস্হা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ থেকে ওমিক্রনের প্রভাব কম হবে। মনেই করা হচ্ছে যে ওমিক্রনে মৃতু্য ঝুঁকি কম। এর কারণে কোনো দেশই পুরোপুরি লকডাউনে যাবে না। হয়তো কোনো কোনো দেশ আংশিক লকডাউনে যাবে। 

তিনি বলেন, ক্রিসমাস ডে উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। উইন্টারের শিপমেন্টও প্রায় শেষ। এখন ইউরোপে তেমন চাহিদা নেই। সেক্ষেত্রে রপ্তানি বাণিজ্যে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। এদিকে ওমিক্রনের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে বলে মনে করেন না বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও। ইউরোপের বড় রপ্তানিকারক হান্নান গ্রুপের চেয়ারম্যান এ বি এম সামছুদ্দিন  বলেছেন, ইউরোপের এখন নীতি হচ্ছে ‘লিভিং উইথ করোনা’ (করোনার সাথে বসবাস)। 

ওমিক্রনের কারণে সেখানে রপ্তানি কমবে বলে মনে হয় না। কারণ এখন প্রচুর অর্ডার আসছে। কাঁচামাল স্বল্পতার কারণে অনেক অর্ডার আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি। বিজিএমইএর সাবেক এই সহ-সভাপতি বলেন, রপ্তানিকারকদের অনেক কাঁচামাল চীন থেকে সংগ্রহ করতে হয়। সেখানে বিদু্যত্ব্যবস্হা রেশনিংয়ের কারণে তারা সময়মতো কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারছে না। এ বি এম সামছুদ্দিন আরো বলেন, ইউরোপের দেশগুলো ইতিমধ্যে তাদের নাগরিকদের ভ্যাক্সিন দেওয়া সম্পন্ন করেছে। বুস্টার ডোজ নিয়েও তাদের অগ্রবর্তী চিন্তা আছে। এর ফলে সেখানে ব্যবসাবাণিজ্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে হয় না। 

সূত্র : ইত্তেফাক


   আরও সংবাদ