ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৬ অগাস্ট, ২০২৩ ১২:০৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ২৫৮ বার
শিক্ষকদের টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপব্যবহার রোধে কঠোর হচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিষয়ের পাশাপাশি অনেকে ধর্ম, রাজনীতিসহ নানা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনায় জড়িয়ে পড়েন। কেউ কেউ এই মাধ্যমের অপব্যবহারও করেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘন হয়। অন্যদিকে তেমনি তৈরি হয় নানা বিভ্রান্তি। এসব রোধে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জড়িত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে আনতে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষক ও বিভিন্ন শিক্ষা অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য চেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। অন্যদিকে, সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্যকারী শিক্ষক ও কর্মচারীদের সতর্ক করে নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ঢালাওভাবে কঠোর মনোভাব পোষণ করলে ভীতি তৈরি হতে পারে। একটি গাইডলাইনের মাধ্যমে এই সংকট দূর করা সম্ভব।
জানা গেছে, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ সরকারের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের পোস্ট দেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পোস্ট দেন ফেসবুকে। ফেসবুক ব্যবহারকারী শিক্ষকদের মধ্যে মূলত তিনটি পক্ষ রয়েছে। একটি পক্ষ সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত থাকে, একটি পক্ষ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে এবং তৃতীয় পক্ষটি সবসময়ই সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত।
আরও জানা গেছে, পদোন্নতি, গ্রেড বৃদ্ধি, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ, এমপিওভুক্তি, জাতীয়করণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সরব। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি পোস্ট দেন তারা। এর মধ্যে অনেকেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, শিক্ষা সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, মাউশি মহাপরিচালক, ডিপিই মহাপরিচালকসহ শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সমালোচনা করে পোস্ট দেন। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছে সরকার। গত ৩ আগস্ট বিভাগীয় উপপরিচালকদের মাধ্যমে এক নির্দেশনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভিন্ন শিক্ষা অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য চেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। আদেশে নির্ধারিত ছকে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাপ্তরিক বা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজ, ব্যক্তিগত বা দাপ্তরিক আইডি, মেসেঞ্জার গ্রুপ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থাকলে সে-সংক্রান্ত তথ্য ইমেইলে ১৭ আগস্টের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
আদেশে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও ব্যক্তিগত আইডিতে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক, কুরুচিপূর্ণ ও নেতিবাচক বিষয়ে পোস্ট, মন্তব্য, লাইক, শেয়ার করা হচ্ছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষকদের দাপ্তরিক বা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজ, ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক আইডি, মেসেঞ্জার গ্রুপ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ সংরক্ষণে রাখা প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণবিধি রয়েছে। সবাইকে এই বিধিগুলো মানতে হয়। অনেক সময় বুঝে হোক, না বুঝে হোক, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করেন, যা চাকরির পরিপন্থি কার্যক্রম। আমরা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এটি (নির্দেশনা) দিয়েছি। কড়াকড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন কেউ বুঝে এগুলো করে, তখন তো আমরা ব্যবস্থা নেবই।
অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষকদের পোস্ট, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার দু-তিন বছর আগেও এত বেশি ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সে কারণে অধিদপ্তর থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, শিক্ষকদের অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে জানেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টের কারণে অনেক শিক্ষকই জেলে যেতে পারেন। সেজন্য আমরা তথ্য চেয়েছি, যাতে তাদের সতর্ক করতে পারি।
শিক্ষকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে গত মাসে সবশেষ নির্দেশনা দেয় মাউশি। জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি নির্দেশনা দিয়েছে। এর পরও অনেক সময় শিক্ষক-কর্মচারীরা তা অনুসরণ না করে সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের এসব কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। নইলে বিধিমোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, যারা সরকারি চাকরি করে তাদের একটা নিয়মনীতির মধ্যে থাকতে হয়। শিক্ষকরা এমন কোনো পোস্ট দিতে পারেন না, যা সরকারের বিপক্ষে যায়। তবে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারে এই সংকট বেশি রয়েছে। এমন সব আপত্তিজনক কথা বলে, মনে হয় যেন কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী। অন্য কোনো ক্যাডারে এমনটা দেখা যায় না। এ কারণেই বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেককে শোকজ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিকের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, উদ্যোগ ভালো হলেও এর নেতিবাচক দিকও দেখতে হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন কমবে, তেমনি সরকারের প্রতি শিক্ষকদের ক্ষোভ বাড়বে। আবার, এর ফলে শিক্ষকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়তে পারেন। একাধিক শিক্ষক নেতা জানান, উদ্যোগটা ভালো হলেও এতে অনেক কর্মকর্তা শিক্ষকদের ওপর চড়াও হতে পারেন। শিক্ষকরা তো অনেক কিছু শেয়ার করেন। দেখা গেল, এটি কোনো কর্মকর্তার ভালো লাগল না, তিনি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন। মোট কথা, এর নেতিবাচক দিক হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের দূরত্ব বাড়বে। অন্যদিকে, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বিগত সময়ে ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা না করেও অনেক শিক্ষক শোকজের আওতায় এসেছেন। এটি সামনে আরও বাড়তে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, আমার পর্যবেক্ষণ হলো—শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণ করেন না। সে বিষয়ে বিধিনিষেধ থাকতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, শিক্ষকরা কোনো বিষয়ে নিজের মতামত দিতে পারবেন না। সরকারের সব সিদ্ধান্তই তাদের মেনে নিতে হবে—এটাও ঠিক নয়। তাতে তারা পুতুল বা রোবট হয়ে যাবেন। শিক্ষকদের গঠনমূলক সমালোচনার জায়গা থাকতে হবে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থারই উন্নতি হবে। তিনি বলেন, কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর কোনো তথ্য বা গুজব ছড়ালে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। শিক্ষক নেতা, সাধারণ শিক্ষক, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা গাইডলাইন তৈরি করা যায়; কিন্তু ঢালাওভাবে নিয়মনীতি করলে শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি ছড়াবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো বাড়াবাড়ি। এতে শিক্ষকদের গোপনীয়তা থাকবে না। শিক্ষকরা কথা বলতে পারলে তাদের ক্ষোভ আর কষ্টের জায়গা জানা যাবে। নইলে ক্ষোভ থেকে নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হবে।