ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১০:০৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫১ বার
ঢাকা: রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা বহু পুরনো। এ যাবৎকালের কোনো সরকারই এ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি।
দেখা গেছে, যাদের হাতে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ছিল, তারাই বিভিন্ন বাহন কোম্পানির মালিক; কেউ আবার মালিক-চালক সমিতির হোতা।
স্বৈরাচার সরকারের আমলে দেশের সড়কে শৃঙ্খলার লেশমাত্র ছিল না। সেই সরকার গত হয়েছে। একই সঙ্গে ‘গত হয়েছে’ সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ট্রাফিক বিভাগেরও। রূপক অর্থে এ বাক্যটি লেখা হলেও পরিস্থিতি তা-ই।
মিরপুর-১ নম্বরের বাসিন্দা আবু সাদাৎ মেহদি নাফি। তার কর্মস্থান বনানীতে। যাতায়াত করেন মিরপুর-১ থেকে কালশি হয়ে। কাজের কারণে সারা ঢাকা শহরে তার যাতায়াত। যেতে হয় মতিঝিল, গুলিস্তানেও। সঙ্গে আছে মোটরসাইকেল। যাতায়াত সহজ হলেও মনে শান্তি নেই তার। কেননা, নতুন স্বাধীন দেশে তিনি সড়কের পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ।
নিজের হতাশার কথা জানান নাফি। বলেন, শেখ হাসিনার আমলে তার দোসররা পরিবহনের বিভিন্ন কোম্পানি খুলে যা ইচ্ছা তাই করেছে। মালিক-চালক-শ্রমিক সমিতিগুলো সড়কের বারোটা বাজিয়েছে। পুরো সিস্টেমটাকে নষ্ট করে ফেলেছে। একই সঙ্গে ট্রাফিক বিভাগও নিজেদের নষ্ট করতে করতে ইজ্জত শেষ করে ফেলেছে। লোকে ট্রাফিক সদস্যদের দেখলে গালাগাল করে। কারণ, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, ২ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ।
তিনি বলেন, বাসা থেকে রাস্তায় নামলেই ভোগান্তি শুরু হয়। দেশের ট্রাফিক সদস্যরা কোনো সিস্টেম জানে না। মিরপুর-১ নম্বরের গোল চক্করে পাঁচ-সাত বছর আগেও তেমন যানজট হতো না। কিন্তু যেদিন থেকে মিরপুর নিউমার্কেটের সামনে থাকা স্ট্যান্ডটিকে বাস-লেগুনা বা অন্যান্য যানবাহন উপেক্ষা করা শুরু করলো। যেখানে স্ট্যান্ড সেখানে না থেকে মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে যাত্রী ওঠা-নামা করা শুরু করলো, সেদিন থেকে যানজট শুরু হতে লাগলো।
মিরপুর-১ নম্বরের বর্তমান বাসস্ট্যান্ডটিও (মিরপুর-১০ হয়ে এসে টেকনিক্যালমুখি) তার সঠিক স্থানে নেই। বাসগুলো যে মোড়টিতে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে বা নামিয়ে দেয় সেটি স্ট্যান্ডের জায়গা নয়। বরং স্ট্যান্ডটি আরও পেছনে। বিএনপি সরকারের সময় সেটি সামনের দিকে নিয়ে আসায় হয় বলে অনেকেই জানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে সরকার প্রদত্ত কোনো চিহ্ন না থাকায় সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি। মিরপুর-১০ হয়ে এসে টেকনিক্যালমুখি বাস স্ট্যান্ডটি পরিচালনা করে সরকার পক্ষে লোকজন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব স্ট্যান্ডের পরিচালনা নাকি লিজের মাধ্যমে দেওয়া হতো!
মিরপুর-১ নম্বরের গোল চক্করে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক ইনচার্জ (টিআই) থেকে শুরু করে প্রায় সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। তাদের ভাষ্য, মিরপুর নিউ মার্কেটটি নতুন। সেটির কর্তৃপক্ষ চায় না মার্কেটের সামনে বাস-লেগুনা থামুক। তাই যারাই এ এলাকায় ট্রাফিকের দায়িত্বে আসেন তাদের সঙ্গে লেনদেন করে কর্তৃপক্ষ। যে কারণে, মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে স্ট্যান্ড পরিচালনা করা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে মার্কেটের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে স্ট্যান্ড পরিচালনা সম্পর্কে সেখানটার টিআই নাম না প্রকাশের অনুরোধে বলেন, পরিস্থিতি কি সেটা সবাই জানে। এমপি থেকে শুরু করে নিম্নস্তরের কর্মীরাও এখান থেকে টাকা খায়। কাউকে তো কিছু বলা যেত না। বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। কিন্তু জুলাই-আগস্টের ঘটনার পর থেকে আমাদের মধ্যেও ভয় আছে। যে কারণে এখন চাইলেও অনেক কিছু করা যাচ্ছে না। আমাদের সফটওয়্যার আপডেটের কাজও চলমান। এগুলো ঠিক হলে সামনের দিনগুলোয় সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে।
মিরপুর-১ থেকে সনি সিনেমা হলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ৩ থেকে চার মিনিটের মধ্যে সেখানে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু সেকশন আলাদা, অর্থাৎ মিরপুর-২ নম্বরের অন্তর্গত হওয়ায় সনির সামনেও একটি ট্রাফিক বুথ রয়েছে। সেখানকার টিআই ও সদস্যদের বিরুদ্ধে রিকশা, অটো রিকশা, লেগুনা বাস থেকে ২ টাকা থেকে ১০০ টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ সাধারণত যাত্রীরাই করে থাকেন।
সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় (মিরপুর-১ থেকে ১০ নম্বর যাওয়ার পথ) কোনো বাসস্ট্যান্ড নেই, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির বাস এসে থামে। যাত্রী ওঠা-নামা করায়, যে কারণে যানজট শুরু হয়। বাসগুলো আবার এমন আড়াআড়িভাবে দাঁড়ায়, যে কারণে অন্যান্য যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি হয়। ট্রাফিক আইনে সড়কে অচলাবস্থা সৃষ্টি করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক সদস্যরা এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেন না।
মিরপুর-১ থেকে ১০, আবার ১০ থেকে ১৪ বা মিরপুর ১২, কালশি, ইসিবি পর্যন্ত রাস্তার প্রতিটি কদমে কদমে একটি করে স্টপেজ বানিয়েছে চালকরা। যেখানে খুশি থেকে যাত্রী ওঠানামা করায় তারা। হুট করে রাস্তায় থেমে যায়। আড়াআড়ি থামিয়ে রেখে পেছনের বাসগুলোকে যাওয়া জায়গা দেয় না। যে কারণে যানজট তৈরি হয়।
রাজধানীতে যানজটের আরেক কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব বাহনের কারণেও সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকগুলোর মনে মৃত্যুর ভয়ও নেই। তারা রাস্তার মাঝে থেমে যায়, উল্টোদিক থেকে এসে অচলাবস্থা তৈরি করে। মিরপুর-১১ নম্বর থেকে কালশি রোডে ৩ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। এসবের চালকরা ১১ নম্বর সড়কের মাঝে অবস্থান করে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাস্তার মোড় দখল করে রাখে। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করে না। একই চিত্র অন্যান্য এলাকাতেও। এসব চালকের অনেকেই জানান, পুলিশ ও ট্রাফিককে ম্যানেজ করতে পারে বলেই তারা অনৈতিক উপায় রাস্তায় চলাচল করে। তাদের রিকশার মালিকরা আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী। তাই রাস্তা ম্যানেজে তাদের কোনো সমস্যা হয় না।
নিজাম উদ্দীন নামে রাজধানীর এক বাসিন্দা বলেন, দেশের ট্রাফিক সিস্টেম ভেঙে ফেলার পেছনে যেমন সরকারের হাত রয়েছে, তেমনি সাধারণ যাত্রীরাও দায়ী। আগা-গোড়া সবাই দোষী। আমরা যখন কিশোর-তরুণ ছিলাম, রাস্তায় বাস বা গণ পরিবহনের সংখ্যা কম ছিল। যাত্রী ছাউনি ছিল, সেখান থেকে বাসে চড়তে হতো। এখন তো যাত্রী ছাউনি কেউ ব্যবহারই করে না। বাস যাত্রীরা নিজেদের পছন্দের জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত তোলে, বাস থামে তারা ওঠে। এদের মধ্যে নিজের চিন্তা ছাড়া আরও কাউকে নিয়ে ভাবনা নেই। বাসটা কোথায় থামছে, দুর্ঘটনা ঘটনার সম্ভাবনা আছে কিনা, আমার কারণে কেউ কোনো সমস্যায় পড়লো কিনা- কেউ ভাবেও না।
তিনি বলেন, এসব ঠিক করতে হলে আগে সাধারণ যাত্রীদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। বাস চালকদের জন্য নিয়ম করতে হবে, প্রতি সপ্তাহে সেগুলোর খোঁজ নিতে হবে। যাকে তাকে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে। যাত্রী ছাউনির ব্যবহারকে আবশ্যক করতে হবে। বাস চলাচলে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাউন্টার করতে হবে। তা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না।
গণপরিবহন হিসেবে যেসব বাস, লেগুনা রাজধানীতে চলাচল করে, সেগুলো কোনো ডিপো আছে কিনা, থাকলেও সেগুলো ব্যবহার হয় কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক ছাত্র ইয়াসিন আরাফাত। তিনি বলেন, দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা অনেকটাই বিকলাঙ্গ। তা ছাড়া যারা পরিবহন ব্যবসা করে তাদের দেশের প্রতি অবদান শূন্য। অনেক কোম্পানির কোনো ডিপো নেই। তারা রাস্তায় বাস, লেগুনা রাখে। কোনো সরকারই এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের কোনো হেলদোল ছিল না। ট্রাফিকেরও হুঁশ নেই। এভাবে স্বাধীন দেশ চলতে পারে? ২০২৮ সালের নিরাপদ সড়ক চাই ও আগস্টে সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীরা যেভাবে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেছে, ট্রাফিক সদস্যরা সেভাবে করতে পারে না। কেন? কারণ, তাদের মাথার ওপর অসভ্য কিছু লোক হাত রেখেছিল। এখন সময় এসেছে সেসব হাত ভেঙে দেওয়া। তা না হলে এই সেক্টরের উন্নতি কখনই হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তার আহ্বান, দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দেশের অর্থনীতিও বাধাগ্রস্ত হবে।
ট্রাফিক সদস্যরা বলছেন, দেশের পট-পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। দ্রুতই এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে কথা হয় ট্রাফিক মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) রাকিব খাঁন বলেন, সড়কের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সচেষ্ট। আমাদের এই জোনটিতে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা খুবই আন্তরিক। যাত্রীদের সমস্যা নিরসনে তারা কাজ করছেন। গত ৫ আগস্টের পর আমরা একটা বিশেষ পরিস্থিতির মুখে আবার দায়িত্ব পালন শুরু করেছি। সব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিছুটা সময় প্রয়োজন। করাপশনের সমস্যা নিরসনে এখনও দৃশ্যমান কোনো কিছু করতে পারছি না, এটা ঠিক। তবে খুব দ্রুতই আমরা এর সমাধান করতে পারব। জনগণ এখন আমাদের সঙ্গে বেশ সম্পৃক্ত হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে জনগণের সম্পৃক্ততা আরও আশা করি।
তিনি বলেন, যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মাঠে আছেন। খুব দ্রুত আমাদের নেওয়া ব্যবস্থাগুলো দৃশ্যমান হবে বলে আশা করছি। আইনের বিষয়ে আমাদের কোনো আপোষ নেই, কোথাও কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে আমরা সরাসরি অ্যাকশনে যাবো। অটোরিকশার যে সমস্যাগুলো সেগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারিনি। তাদের দৌরাত্ম্য থামছে না। তবে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলাপ করছি। তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। যদি তারা আইন না মানে আমাদের শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে মামলা-জরিমানার দিকেও যাচ্ছি। তবে ট্রাফিক মামলাবাজ হয়ে উঠবে, এমন কোনো কিছুই আমরা হতে দেব না। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আমরা আমাদের কাজ করতে চাই।
এ সময় রোববার (৮ আগস্ট) রাত থেকে মিরপুরের পাঁচটি পয়েন্টে রাত ২টা পর্যন্ত ট্রাফিক ডিউটি চলবে। এবং অচিরেই দৃশ্যমান পরিবর্তন জনগণ দেখবে বলে জানান উপ-পুলিশ কমিশনার রাকিব খাঁন।