ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৭১০ বার
অপরাধ ডেস্ক: পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র রাজধানীর বিভিন্ন থানাতেই ১৭টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে মারধর, হত্যার উদ্দেশ্যে করা আঘাতে গুরুতর জখম, চুরি, হুমকি এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় কাজে গোলযোগের অভিযোগ এনে মোহাম্মদপুর থানায় মামুনুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। এ মামলায় পুলিশ তাঁকে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করবে।
সোমবার (১৯ এপ্রিল) তাকে আদালতে পাঠানো কথা রয়েছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগে তদন্তাধীন আটটি মামলা, লালবাগ বিভাগে তদন্তাধীন দুটি মামলা ও তেজগাঁও বিভাগে তদন্তাধীন একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হেফাজত নেতা মামুনুল হক।
এছাড়া মতিঝিল থানায় তদন্তাধীন একটি ও পল্টন থানায় তদন্তাধীন চারটি মামলায় তার নাম রয়েছে। উল্লিখিত ১৬টি মামলার মধ্যে ১৫টিই হয়েছে ২০১৩ সালের ৫মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের পর। ওই ১৫ মামলার বাদী পুলিশ। ১৬ মামলার অন্যটি সম্প্রতি পল্টন থানায় দায়ের করেন যুবলীগের এক নেতা। জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররম এলাকায় পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে হোফজতের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও সংঘর্ষের পর মামুনুলের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। ১৭ নম্বর মামলাটি হলো মোহাম্মদপুর থানার মামলা।
এর আগে, রবিবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরদারিতে ছিলেন।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ সালে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হামলা-ভাঙচুরের মামলায় মামুনুলকে প্রথম গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বের নাশকতার ঘটনায় ঢাকায় সাতটিসহ ৩৩টি মামলার আসামি তিনি। আগেও দুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন মামুনুল। সম্প্রতি পল্টন, মতিঝিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সোনারগাঁসহ কয়েকটি থানার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। ২০১৩ সালের একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাঁকে গ্রেপ্তার দেখাবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৩ সালের মামলার তদন্তে মামুনুলের নামও উঠে এসেছে। কয়েকটি মামলায় তিনি চার্জশিটভুক্ত আসামি। ওই সব মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।’
গত এক সপ্তাহে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় ও মহানগর পর্যায়ের আটজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর তাঁরা এখন পুলিশের রিমান্ডে আছেন। গতকাল তিনজনের সাত দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত।
অন্যদিকে মামুনুলের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। গতকাল এক বিবৃতিতে দলটির নেতারা এই দাবি জানান। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকেও তাঁর মুক্তি দাবি করা হয়েছে। তবে সংগঠনটি এখন কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি দেবে না বলে জানিয়েছেন নেতারা।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা থেকে আটক করে মামুনুলকে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমাদের মোহাম্মদপুর থানায় ২০২০ সালের ভাঙচুরের একটি মামলা ছিল। আমরা তদন্ত করছিলাম। তদন্তের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়েছি, ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত। এ মামলায় আমরা তাঁকে জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছি।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনায় মামুনুল আমাদের নজরদারিতে ছিলেন। মাদরাসায় অবস্থান করছিলেন। আমরা কৌশলে তাঁকে নিয়ে আসি। এতে তেমন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।’ তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর থানার মামলায় আজ মামুনুলকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ।
এরপর দুপুরেই মামনুলকে তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ, মামলার ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মিন্টো রোডের পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। তেজগাঁও থানায় জিজ্ঞাসাবাদে মামুনুল তিন বিয়ের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, যে দুই নারীর কথা আলোচনায় এসেছে তাঁরা দুজনই তাঁর স্ত্রী। এসব বিয়ে তিনি সামাজিকভাবে গোপন রেখেছেন।
ঢাকা মহানগর ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘মামুনুল হক ২০১৩ সালের সহিংসতা এবং সাম্প্রতিক সহিংসতায়ও নিজে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং উসকানি দিয়েছেন। তাঁকে প্রথমে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আগামীকাল (সোমবার) আদালতে পাঠানো হবে।’
যেভাবে গ্রেপ্তার : পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ৩ এপ্রিল রিসোর্টকাণ্ডের পর থেকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসায় ছিলেন মামুনুল। তিনি ওই মাদরাসার শিক্ষক। মাদরাসার দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকতেন। দু-একবার বের হয়ে দলীয় সভায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি টের পেয়ে আর বের হননি। গত এক সপ্তাহে কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর অনেকটা আত্মগোপনেই ছিলেন তিনি। ফেসবুক লাইভে দ্বিতীয় স্ত্রীর ব্যাপারে বক্তব্য দিয়ে তা সরানোর পরই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করেন মামুনুল। তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য পাওয়ার পর তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা পায় পুলিশ। গতকাল সকাল থেকেই মাদরাসার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। সেখানে ছাত্রের সংখ্যা কম দেখে দুপুরে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করার জন্য যায় সাদা পোশাকের ও পোশাকধারী পুলিশের দল।
অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মাদরাসার গেটে সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়েছিলেন মামুনুল হক। পুলিশের শতাধিক ফোর্স সেখানে গেলে প্রথমে বাধা দেওয়া হয়। বাধা উপেক্ষা করে দ্বিতীয় তলায় মামুনুলের কক্ষে গিয়ে পুলিশ তাঁকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। তিনি নিজেও বুঝতে পারেন, বাধা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তখন তিনি স্বেচ্ছায় হেঁটে গাড়িতে ওঠেন। এ সময় সঙ্গে কয়েকজন সহকর্মীও তেজগাঁও কার্যলয়ে আসেন। গাড়িতে ওঠার সময় কয়েকজন স্লোগানও দেয়।
যত অভিযোগ আর মামলা : ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে নাশকতার পর গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে আলোচনায় আসেন মামুনুল। এরপর ডিসেম্বরে কুষ্টিয়া শহরে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়।
এ ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী ও মামুনুলের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুপল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটে। গত ২৫ মার্চ থেকে নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে হেফাজতের কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেন তিনি। ২৬-২৮ মার্চ সংগঠনটির বিক্ষোভ ও হরতাল কর্মসূচিতে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাশকতা চালানো হয়। হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থানা ও সরকারি-বেসরকারি অনেক স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হয়। এ ঘটনার পর গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁয় রয়েল রিসোর্টে নারী সঙ্গীসহ স্থানীয় লোকজনের হাতে অবরুদ্ধ হন মামুনুল। ওই নারীকে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেন। হেফাজতের নেতাকর্মীরা রিসোর্টে হামলা-ভাঙচুর চালিয়ে তাঁকে ‘ছিনিয়ে’ নিয়ে যান। এ ঘটনার পর সংসদে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মামুনুল হক ‘অপবিত্র কাজ করে’ সোনারগাঁর বিসোর্টে ধরা পড়েছেন। জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করা এবং ধর্মের নাম নিয়ে ‘অধর্মের’ কাজের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ওই সময় মামুনুলের একাধিক বিয়ে নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হয়। ১০ এপ্রিল মামুনুলের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে মায়ের সন্ধান ও নিজের নিরাপত্তা চেয়ে পল্টন থানায় জিডি করেন। ১১ এপ্রিল নিজের বোনকে মামুনুল হকের স্ত্রী দাবি করে তাঁর সন্ধান চেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেন শাহজাহান নামের আরেকজন। তখন থেকে জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে লিপি নামে মামুনুলের কথিত তৃতীয় স্ত্রীর কথা জানা যায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের নাশকতায় মতিঝিল ও রমনা বিভাগের সাতটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মামুনুল হক। একটি মামলার অভিযোগপত্রে তাঁর নাম আছে এবং এরই মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। হেফাজতের নেতাদের ভাষ্য মতে, ২০১৩ সালে মামুনুলের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ২৬ মার্চ নাশকতার ঘটনায় পল্টন ও মতিঝিল থানার দুটি মামলার এজাহারে মামুনুলের নাম আছে। সোনরাগাঁর একটি মামলায় তাঁকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের মামলায়ও আসামি মামুনুল। সব মিলে অর্ধশত মামলায় ফেঁসে যেতে পারেন তিনি।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ মে খুলনায় একবার গ্রেপ্তার হন মামুনুল। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
এদিকে শনিবার গ্রেপ্তারের পর হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি জুনায়েদ আল হাবীব, সহকারী মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব জালাল উদ্দিনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান। এর আগে ১২ এপ্রিল পল্টন থানার মামলায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকেও সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে আরো পাঁচ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।