ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ডা. সাবিরা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো অন্ধকারে

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৮৩১ বার


ডা. সাবিরা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো অন্ধকারে

আইন আদালত: রাজধানীর কলাবাগানে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি (৪৭) হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ। এগারো দিন পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি তারা। ঘটনার পর থেকে সন্দেহভাজন, প্রত্যক্ষদর্শী, সহকর্মী ও অনেক স্বজনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো ক্লু (সূত্র) মেলেনি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে ছেড়ে দেয়া হলেও এদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রাখছেন গোয়েন্দারা।

গত ৩১ মে সকালে কলাবাগানের ফার্স্ট লেনের ৫০/১ ভবনের তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে ডা. সাবিরার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অবশ্য ওই ফ্ল্যাটে প্রথমে আগুনের খবর পেয়ে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিস। পরে যায় কলাবাগান থানা পুলিশ। তার শরীরে একাধিক গভীর ক্ষতের চিহ্ন দেখে পুলিশ তখন জানায়, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের এই নারী চিকিৎসককে।

এ ক’দিনে ঘটনার আলামত বিশ্লেষণ ও অন্যান্য তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে কাজী সাবিরাকে। ধারণা করা হচ্ছে, ফজরের নামাজের আগে তাকে খুন করা হয়। প্রথমে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয় তাকে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলায় ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করা হয়। হত্যাকাণ্ড ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ওই কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, পারিবারিক কোনো কারণে স্বজনদের হাতে খুন হতে পারেন সাবিরা। তবে এখনই সেটা নিশ্চিত করে বলতে চাইছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

তদন্তে পুলিশের সব ইউনিট
হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটনে বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিট একযোগে কাজ করছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি একটি বিরল ঘটনা। থানা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই, ডিবি, সিআইডি ও র‍্যব কাজ করছে হত্যাকাণ্ডটি তদন্তে। এখন ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তদন্ত চলছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ডটি ক্লুলেস ও জটিল হলেও বলা যায়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে সাবিরাকে। খুনি ফ্ল্যাটের সব তথ্যই জানত। এমনকি তার কাছে ফ্ল্যাটের মূল দরজার নকল চাবিও ছিল। ফলে পালাতে সুবিধা হয় খুনির। এক্ষেত্রে বাড়িটির দারোয়ানের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করাও খুনির বাড়তি সুবিধার জায়গা ছিল।

সূত্র জানায়, ডা. সাবিরার কক্ষের দরজায় অটোলক সিস্টেম ছিল। হত্যাকারী তার কক্ষ থেকে বেরোনোর সময় বাইরে থেকে দরজা টান দিয়ে লক করে যায়। যার কারণে দরজাটি ভেঙে পুলিশকে সাবিরার কক্ষে ঢুকতে হয়।

ওই ফ্ল্যাটে আগুন লাগার বিষয়ে সূত্র জানায়, আগুন ধরলে নিচ থেকে জ্বলার কথা, কিন্তু কাউকে যদি আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় তখন তা ওপর থেকে জ্বলতে পারে। সাবিরার মরদেহ বিছানায় উপুড় হয়ে ছিল। বিছানায় শুইয়ে দেয়ার পরে আগুন শরীরের ওপর থেকে ধরানো হয়। তার কক্ষের দরজা-জানালা বন্ধ থাকার কারণে আগুন বেশি ছড়াতে পারেনি।

আরেকটি সূত্র বলছে, সাবিরার বাসায় পোড়া সিগারেটের দুইটি অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। এটিকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসাবে দেখছে তদন্তকারী সংস্থা। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ দুইটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ বলছে, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ দুইটি উদ্ধার হলেও কক্ষে সিগারেটের ছাঁই রাখার কোনো পাত্র পাওয়া যায়নি। ডা. সাবিরা নিজে নাকি অন্য কেউ ধুমপান করেছেন, সেটা বের করতে ফিঙ্গার প্রিন্ট উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।

স্বজন-সহকর্মী সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ
ঘটনার পাঁচ দিন আগে থেকে ভোরে হাঁটতে বের হতেন সাবিরার সহ-ভাড়াটিয়া মডেল কানিজ সুবর্ণা। এই কানিজ সুবর্ণাকেই সন্দেহ করছে সাবিরার স্বজনরা। এই নারী চিকিৎসকের মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল কলাবাগান থানায় যে হত্যা মামলা করেছেন, তাতেও কানিজ সুবর্ণার দিকে সন্দেহের কথা উল্লেখ রয়েছে।

কেবল কানিজ সুবর্ণা নন, গত ৬ জুন দিনভর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাবিরার আরেক সহ-ভাড়াটিয়া নুরজাহানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। নুরজাহান হত্যার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, গত ঈদুল ফিতরের দিন থেকে তিনি গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে ছিলেন।

সাবিরার আত্মীয়-স্বজন যারা আছেন মোটামুটি সবাইকেই দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ডা. সাবিরার প্রথম স্বামীর আত্মীয় থেকে শুরু করে দ্বিতীয় স্বামী ও তার আত্মীয়দেরও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। এমনকি সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথমে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তাদের ফের ডাকা হচ্ছে। ডা. সাবিরা যে হাসপাতালে চাকরি করতেন সেই হাসপাতালের কয়েকজন সহকর্মীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া মডেল কানিজ সুবর্ণার বন্ধু মাহাথির মোহাম্মদ স্পন্দন, বাড়ির দারোয়ান রমজান আলী ও গৃহকর্মীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

পরিবার থাকতেও সাবিরা একা কেন থাকতেন?
ডা. সাবিরার এক স্বজন জানিয়েছেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নিজের কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল সাবিরার। সেখান থেকে কয়েকজনের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে কাদের সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। সাবিরা আট থেকে নয় বছর ধরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চাকরি করছেন। বছর পাঁচেক আগে তার চাকরি স্থায়ী হয়। কাজ করতেন রেডিওলজি বিভাগে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসে কয়েকটি হাসপাতালে চাকরির পর সর্বশেষ তিনি যোগ দেন গ্রিন লাইফ হাসপাতালে।

২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ডা. সাবিরার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর হয়। এরপর ২০০৫ সালে শামসুর আজাদ নামের একজন ব্যাংকারকে বিয়ে করেন তিনি। দুই সংসারে তার দুই সন্তান রয়েছে। প্রথম সংসারের ছেলের বয়স ২১ বছর। তিনি গত কয়েক মাস ধরে কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর দ্বিতীয় সংসারের একমাত্র মেয়ের বয়স ১০ বছর। মেয়েটি কলাবাগানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। ছেলেটি থাকেন তার নানীর সঙ্গে আর মেয়েটি থাকে তার বাবার সঙ্গে। সাবিরার মা থাকেন কলাবাগানে। বর্তমান স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ডা. সাবিরা আলাদা থাকতেন বলে জানা গেছে।

যদিও পারিবারিকভাবে বলা হচ্ছে, কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালে যাতায়াতের সুবিধার্থে সাবিরা কলাবাগানের ওই ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকতেন। তবে দ্বিতীয় সংসারের ১০ বছরের মেয়েটি মাঝে মাঝে তার কাছে এসে থাকত।

হত্যা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি
সাবিরার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধারের ৩৬ ঘণ্টা পর কলাবাগান থানায় মামলা করেন তার মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল। তবে মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলাটি করা হয়।

কলাবাগান থানা সূত্রে জানা যায়, মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ এবং ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। অবশ্য সাবিরা খুন হয়েছেন, এমনটা ধরে নিয়েই মামলা হওয়ার আগে থেকে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।


   আরও সংবাদ