ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

আতঙ্ক বাড়ছে ফেসবুক-ইউটিউবে

বিনোদন ডেস্ক


প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:১৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১১০২ বার


আতঙ্ক বাড়ছে ফেসবুক-ইউটিউবে

সম্প্রতি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও চ্যাটের 'আপত্তিকর' ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় সবুজ নামের স্থানীয় এক তরুণ। এ ঘটনায় ৪ সেপ্টেম্বর পুলিশ অভিযুক্ত তরুণকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, স্বামীর অবর্তমানে ওই গৃহবধূ প্রায়ই সবুজের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করতেন। সবুজ এ সময় অশ্লীল কিছু দৃশ্যের স্ক্রিনশট রাখেন। পরে ওই নারীর নামে ফেসবুক আইডি খুলে এসব ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেন তিনি।
 
বগুড়ার শাজাহানপুরে গত ১৩ জুলাই এক তরুণী গৃহবধূ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় পুলিশ চার ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, ওই গৃহবধূর সঙ্গে গোলাম রাব্বী নামের এক তরুণের ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঘটনার দিন রাব্বী তাকে একটি ফাঁকা বাসায় ডেকে নিয়ে ৫ বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে। পরে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে সেই দৃশ্য অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু নারী হয়রানিই নয়, এর মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সমাজ-সংসার ও দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো, উগ্রবাদের বিস্তার ও বিকৃত যৌন চর্চাসহ নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বিস্তার ঘটছে। ষড়যন্ত্রকারী চক্রের কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তথা দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন্নের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এমনকি এ মাধ্যম ব্যবহার করে তারা দেশের বিচারবিভাগকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া নির্বাচনের আগে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে সরকার ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কঠোরভাবে মনিটর করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরইমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।র্ যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাও এ ব্যাপারে তৎপরতা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের আইজি ডক্টর বেনজীর আহমেদ বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়মিত মনিটর করার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে কোনো সাধারণ নাগরিক সাইবার ক্রাইমের শিকার না হন। একই সঙ্গে তিনি পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশ বাহিনীর অনুশাসন মেনে চলার নির্দেশ দেন।

গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের অনলাইন ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রায় ৫ শতাংশ ইউজার না বুঝে, বিভিন্ন উসকানিমূলক পোস্ট ও ভিডিও শেয়ার করে বিপাকে পড়েছেন। ইউটিউব, ফেসবুক

টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, স্কাইপে ও রেড্ডিটের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো উদ্দেশ্যমূলক পোস্ট কিংবা ভিডিওতে ১৫ শতাংশের বেশি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ মাধ্যমের অপব্যবহারে সংসার ভেঙেছে লাখো মানুষের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী সাদেকা হালিম যায়যায়দিনকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ সচেতন নন। বিশেষ করে টিনএজ তরুণ-তরুণীরা আবেগের বশবর্তী হয়ে এর ভুল ব্যবহার করছে। তারা যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলছে। অপরিচিতজনের পোস্ট ও ভিডিও যাচাই না করে শেয়ার করছে। যা পরবর্তী সময়ে তাদের বড় ধরনের বিপদে ফেলছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

আইটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন ব্যবহার করে দেশের তরুণ প্রজন্মের ক্রিয়েটিভিটি প্রদর্শনে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং তরুণের পাশাপাশি যুবক-বৃদ্ধ অনেকেই এর অপব্যবহারে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। তাদের একটি অংশ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড করছে। এটি 'ডিজিটাল কোকেন' অ্যাডিকশনের মতো হয়ে গেছে। বিশেষ করে করোনাকালে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা এটি উসকে দিয়েছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। তারা গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট, ছবি আপলোড, চ্যাটিং বা হোমপেজ ব্রাউজিংয়ে সময় দিচ্ছে। এ জগতের আসক্তি ছাড়তে না পেরে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি খোয়াচ্ছে। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় এ মাধ্যমে যুক্ত থাকতে গিয়ে শত শত মানুষ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে।

এদিকে 'ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয়বিদ্বেষ ও গুজব ছড়ানোর ঘটনাও কম নয়। গত কয়েক বছরে দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করে যতগুলো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে' সবই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। ফেসবুক ব্যবহার করে মেডিকেলসহ বিভিন্ন পাবলিক ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাও ঘটেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রম্নপে বিকৃত যৌন চর্চারও বিস্তার ঘটেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব গ্রম্নপের সদস্যদের তৎপরতা বাড়ছে। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে ফাঁদ পেতে নারী-পুরুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। বস্ন্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে ভুক্তভোগীর আত্মহত্যার নজিরও রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশব্যাপী পুলিশের পৃথক ১০০টি সাইবার টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি টিমে পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন সহকারী উপমহাপরিদর্শকের (এআইজি) নেতৃত্বে এ টিমকে পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে বেশকিছু উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। আরও কিছু প্রযুক্তি আমদানির প্রক্রিয়া চলছে।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা প্রচার ও গুজব ছড়াচ্ছে- এমন সহস্রাধিক ফেসবুক পেজ ও গ্রম্নপ চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অ্যাডমিনদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বিভ্রান্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে উসকানি দেওয়া হচ্ছে এমন বেশকিছু ইউটিউব চ্যানেল চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের বাইরে অবস্থান নিয়ে অনেক ভুয়া আইডি থেকেও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এতে জনমনে নানা শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো বন্ধেরও চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ইউনিটের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, সাইবার পুলিশ প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সাইবার টহল দিচ্ছে। রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিছু পাওয়া গেলে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, পুলিশ,র্ যাব, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার দমন ইউনিটগুলো আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অপরাধী শনাক্তে নানা ধরনের উন্নতমানের ডিভাইস ও সফটওয়্যার যুক্ত করা হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক, অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ থাকে তখন এর মাধ্যমে অপরাধ, বিশৃঙ্খলা, উসকানি ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়। আমাদের দেশে এটিই বর্তমানে হয়েছে। সম্প্রতি ষড়যন্ত্রকারী চক্র এ মাধ্যম ব্যবহার করে নানা অপরাধের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই এ ব্যাপারে দ্রম্নত কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। ফেসবুক আইডি তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি ভেবে দেখার সুপারিশ করে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করার নামে স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাই এর লাগাম টেনে না ধরলে ষড়যন্ত্রকারীরা আগামীতে সমাজে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাতে পারে।

তৌহিদুল হক আরও বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা নিজেদের অসচেতনতার কারণে অনেক সময় নিজেদের ভিকটিম করে ফেলছে। তাই এ ব্যাপারে তাদের সচেতন করা জরুরি।


   আরও সংবাদ