ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিএমডিএ

স্টাফ রিপোর্টার


প্রকাশ: ৬ অক্টোবর, ২০২১ ১৫:৩৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৭৩২ বার


উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিএমডিএ

বাবুল আকতার,সাপাহার(নওগাঁ)প্রতিনিধি: নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার শিতল ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ(৭০) বলেন, ১৯৮৫ সালের আগে আমাদের এলাকায় বছরে একটি ফসল হতো। সেটাও বৃষ্টির পানিতে। একরে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান উৎপাদন হতো। তবে যে বার বৃষ্টি সময় মতো হতো না সেবার কোনো ফসলে ঘরে আসতো না। এখন একরে ৮০ থেকে ৯০ মণ পর্যস্ত ধান উৎপাদন হচ্ছে। কিছু কিছু জমিতে তিনটির বেশি ফসল হয়। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) স্থাপিত গভীর নলকুপের পানি গম, ধান, শাক-সবজি, আমের বাগানসহ সব ধরনের ফসল উৎপাদনের ব্যবহার হয়। এমনি অল্প খরচে সুপেয় পানিও সরবরাহ করছে এই বিএমডিএ। ১৯৯০ সালের আগেও মরুর মতো ছিল ঠাঁঠাঁ বরেন্দ্র এলাকা। এখন সব পাল্টে সবুজে পরিণত হয়েছে।

উপজেলার রামরামপুর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম (৫৫) বলেন, বর্তমানে সাপাহারে শত শত হেক্টর এলাকা জুড়ে আমের চাষ হয়। এটাকে সৃষ্টি কর্তা বাঁচিয়ে রাখছে বিএমডিএ-এর পানির মাধ্যমে। পানির সঠিক সেচ ব্যবস্থা থাকায় আম পুষ্ট এ সুমিষ্ট হয়। আম এই দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে সাপাহারের আম। এই সাফল্যের দাবিদার কৃষি সম্পাসারণ কার্যালয় ও বিএমডিএ।

বিএমডিএ-এর সাপাহার জোনের সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, উপজেলায় ৩২৩ টি নলকূপসহ, এলএলপি, সৌর শক্তি চালিত এলএলপি, খাস মজা খাল পুনঃ খনন, খাবার পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাংকি নির্মাণ, বনায়ন সহ পানির সঠিক ব্যবহারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

বিএমডিএ-এর নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ জানান, বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়ন কৃষি ও কৃষি পরিবেশে এবং সেচ অবকাঠামো উন্নয়নসহ সেচ এলাকা ও আবাদী জমি স¤প্রসারণ, মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বিপণন এবং পরিবেশ উন্নয়নে ফলদসহ অন্যান্য বৃক্ষ রোপনে কাজ শুরু করে কৃষি সেক্টরে সফলতার সাথে এগিয়ে চলেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। বরেন্দ্র এলাকাকে দেশের শস্যভাÐারে রুপান্তর এবং মরুময়তা রোধকল্পে বনায়ন ও সম্পূরক সেচের জন্য খাল-দিঘী পুনঃখনন। ছাড়াও গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্য বাজার জাত করণ এবং জীবণ যাত্রার মান উন্নয়নে কাজ শুরু করে।

কর্তৃপক্ষ সেচে ভূপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের উন্নয়ন ও যথাযথ ব্যবহার। কৃষি যান্ত্রিকিকরণ, বীজ উৎপাদন, সরবরাহ শস্যের বহুমুখীকরণ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ রোপন ও সংরক্ষণ। সীমিত আকারে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও রক্ষাবেক্ষণ। সেচযন্ত্র স্থাপন এবং লোকালয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ। গবেষণা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে বিএমডিএ-এর কার্যক্রম শুরু করেন কর্তৃপক্ষ।

বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ জানান, ১৯৮৫ সালে পূর্বে লাল কংকরময় মাটির উঁচু নীচু টিলা, ছায়াহীন এক রুক্ষ প্রান্তর বরেন্দ্র অঞ্চল। চোখের

দৃষ্টি সীমায় রোদে পোড়া বিরান ফসলের মাঠ। কোথাও পানির ছিটেফোটাও নেই। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে প্রাণ ওষ্ঠাগত শীর্ণকায় কৃষক, তার চেয়ে অধিক শীর্ণকায় তার হালের বলদ। দূরে বহুদুরে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে বাবলা আর ক্যাকটাসের বেড়া। এই হলো আমাদের বরেন্দ্র ভূমি। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রাচীনকালে বরেন্দ্র ভূমির চিত্র ভিন্ন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির প্রসারকালে এ অঞ্চল কৃষি ও শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশও সে সময় বেশ চমৎকার ছিল।

ইতিহাসবিদ নেলসনের (১৯২৩) মতে বরেন্দ্র অঞ্চল জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। উইলিয়াম হান্টারের (১৮৭৬) বর্ণনা মতে বাংলার প্রায় সব ধরনের গাছই এ অঞ্চলে পাওয়া যেত। আম, জাম, তেঁতুল, তাল, খেজুর, বট, পাইকড়, শিমুল, বাবলা, বরই, বাঁশ, বেতসহ অসংখ্য লতা গুল্মের প্রাচুর্য ছিল এ বরেন্দ্র ভূমিতে। কিন্তু বৃটিশ শাসনামলের সময় লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি জমির স¤প্রসারণ, বসতবাড়ী স্থাপন, শিল্পে কাঁচামালের যোগান, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী, জ্বালানী হিসেবে কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণের কারণে তিলতিল করে ধ্বংস হয়েছে অত্র এলাকার বনভূমি। মূলত ঐ সময় থেকেই এ অঞ্চলে মরূকরণ প্রক্রিয়ার শুরু হয়।

পরিবেশের স্বাভাবিক নিয়মে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। দেশের বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত যেখানে ২৫০০ মি.মি. সেখানে এ অঞ্চলে তা ১৪০০ মি.মি. এর বেশী নয়। ভাটির দেশ হওয়ায় উজানের দেশ থেকে নেমে আসা প্রায় সকল নদীতে বাঁধ সৃষ্টি/স্থাপন করায় অধিকাংশ নদীই (মহানন্দা, আত্রাই, পূর্ণভবা, শিব, পাগলা, করোতোয়া, তিস্তা) শুকনো মৌসুমে প্রায়ই শুকিয়ে যায়। এছাড়াও নদী বা খালে পানির প্রবাহ না থাকায়/কমে যাওয়ায় পলি জমে অধিকাংশ নদ-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে পর্যাপ্ত পানি ধারণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। ফলে এ অঞ্চলে

ভূ-পরিস্থ পানির উৎসও খুবই অপ্রতুল হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলের জমিগুলো ছিল তাই বৃষ্টি নির্ভর এক ফসলী। যথা সময়ে বৃষ্টিপাত না হলে একটি ফসল উৎপাদনও ব্যহত হতো। বৃষ্টি নির্ভর বোনা আমন ফসলের পর বছরের বাকী সময় জমিগুলো গোচারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দীর্ঘ কাদাস্তর ভেদ করে মাটির গভীর আধার থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলনও সহজ ছিল না। তাই সেচ কার্যক্রমতো দূরের কথা এলাকাবাসী খাবার পানিসহ গৃহস্থালীর নানা কাজে পুকুর, খাল বিলের পানি ব্যবহার করতো। ঠিক ভাবে ফসল উৎপাদন না হওয়ায় এ এলাকার জনসাধারণ অত্যন্ত দরিদ্র ছিল। তারা তিন বেলা পেটপুরে খেতে পেত না। এমনকি অনেক জোতদারেরাও অভাবী ছিল। তাই কাজের সন্ধানে এখানকার জনসাধারণ নিয়মিত অন্যত্র গমন করতো।

মাটির গঠন এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তরের স্বল্পতার কারণে এ অঞ্চলে প্রচলিত গভীর নলকূপ দ্বারা সেচ কাজ সম্ভব ছিল না। সে প্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালে এ অঞ্চলের তৎকালীন বিএডিসি’র প্রকৌশলীগণ এক বিশেষ ধরণের গভীর নলকূপ উদ্ভাবন করে ভূ-গর্ভস্থ পানি দ্বারা সেচের সুযোগ সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এর আওতায় বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (ইওঅউচ) এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ১৫ টি উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুকুর-খাল খননের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সৃষ্টি করা, বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে মরু প্রক্রিয়া রোধ করা এবং উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করা ও যাতায়াতের জন্য ফিডার রোড নির্মাণ করা ছিল এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সময়ের স্বল্পতা, অর্থায়নের প্রতিকুলতাসহ নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতায় প্রকল্পের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয় কিন্তু অল্প সংখ্যক হলেও উল্লেখিত কার্যক্রম সমূহ এ এলাকার মানুষের মনে বিরাট আশার আলো জাগায়।

বরেন্দ্র এলাকার বিরান ভূমিতে সোনালী ফসলের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে পরবর্তীতে সমগ্র বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়নের জন্য ১৯৯২ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার সকল (২৫টি) উপজেলাকে অন্তÍর্ভুক্ত করে বিএমডিএ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।

মণিটরিং বিভাগ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে ২০১৮ সালে জারীকৃত "বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৮" এর মাধ্যমে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি (সকল) জেলাকেই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উক্ত আইন অনুসারে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালককে সদস্য-সচিব করে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও আইন মোতাবেক কৃষি মন্ত্রীকে সভাপতি করে প্রতিমন্ত্রী, বরেন্দ্র এলাকার সকল সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএডিসি, বিএমডিএ ও বিএআরসি’র চেয়ারম্যান, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার, কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী প্রধানগণ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৮ শত ৯৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত। যাদের মধ্যে ১৯৪ জন সহকারী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী রয়েছে। এসব নিয়ে এগিয়ে চলেছে এক সময়ের বেসরকারি ভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি।

অর্জন
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৬ জেলায় ১৫৭৯৩ টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। ১৩৫০১ কিঃ মিঃ এলাকায় সেচের পানি বিতরণ ব্যবস্থা নির্মাণ। ৫৩২ টি এলএলপি স্থাপন। ১১৯ টি সৌর শক্তি চালিত এলএলপি। ২০২৪ কিঃ মিঃ খাস মজা খাল পুনঃ খনন। ৭৪৯ টি ক্রসড্যাম নির্মাণ। ১১ টি নদীতে পল্টুন স্থাপন। ৩১৪০ টি খাস মজা পুকুর পুনঃ

খনন। (৯৮০০+১০৫০)=১০৮৫০ হেক্টর জলাবদ্ধতা নিরসন- নওগাঁ জেলার রক্তদহ বিল, টেপাবিল, মনছুর বিল এবং রাজশাহী জেলার ছত্রগাছা বিল, দেবর বিল ইত্যাদি বিলের। ৫৭২ টি সোলার ডাগওয়েল নির্মাণ। ১১৪৪ কিঃ মিঃ সংযোগ রাস্তা নির্মাণ। ১৫৭৯ টি পরিবারের খাবার পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ। বনায়নের লক্ষ্যে ২ কোটি ৫৮ লক্ষ টি বৃক্ষ। প্রতি বছর ৬০০ মেঃ টন বীজ উৎপাদন। ১ লাখ ৪৮ হাজার ২১৮ কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে গভীর নলকূপ ১৫৫৪১ টি ও এলএলপি ৫১৬ টি সেচযন্ত্র ব্যবহার। আবাদযোগ্য জমি ২৬ লাখ ৪১ হাজার ১৬ হেক্টর এবং সেচকৃত জমি ২২ লাল ৭ হাজার ৪ শত ৯৯ হেক্টর (আবাদযোগ্য জমির ৮৩.৫১%)। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে বিএমডিএ কর্তৃক সেচকৃত জমি প্রায় ৫.২৫ লক্ষ হেক্টর সেচকৃত এলাকা (২০১৯-২০)। প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে ১১৭ এবং বর্তমানে ২৩০ ফসলের নিবিড়তা (%)। প্রায় ৯.৮৯ লাখ কৃষক পরিবার উপকৃত হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহ রয়েছে আরো ৮টি। সব মিলিয়ে উত্তরাঞ্চলের ঠাঁঠা বরেন্দ্র ভুমিতে বিএমডিএর বদৌলতে আজ সৃষ্ঠি হয়েছে সবুজের সমারহ। এক সময়ের ধুঁ-ধুঁ প্রান্তরের বুক জুড়ে চোখে পড়বে দিগন্তজোড়া ফল ও ফসলের মাঠ। বরেন্দ্র এলাকার মানুষের জীবণ মান উন্নয়নে বিএমডিএর কর্মসুচী গুলো আর্শীবাদে পরিনত হয়েছে।


   আরও সংবাদ