ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১ ডিসেম্বর, ২০২১ ২৩:২৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৪০ বার
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র মাসব্যাপী অনুষ্ঠানসূচি আজ (১ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম থেকে আরম্ভ হয়েছে। সংগঠনের চট্টগ্রাম শাখার উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাঙালির অবিস্মরণীয় বিজয়’ শীর্ষ ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রাক্তন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম এবং প্রধান বক্তা ছিলেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।
ভারত থেকে সংযুক্ত হয়ে ওয়েবিনারের শুরুতে আবৃত্তি করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আবৃত্তি শিল্পী ও গবেষক ডালিয়া বসু সাহা। চট্টগ্রামের বিভাগীয় সমন্বয়কারী সাংবাদিক শওকত বাঙালির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে আলোচক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবেদ খান, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, মানবাধিকার নেত্রী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবির, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক হাসিনা জাকারিয়া বেলা, চট্টগ্রাম মহানগর কমাণ্ডার মোজাফফর আহমেদ, প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি পেশাজীবী নেতা প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলার সহ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক সমাজকর্মী সুচিত্রা গুহ টুম্পা প্রমুখ।
প্রধান বক্তার ভাষণে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, ‘বাঙালি জাতির লিখিত অলিখিত ইতিহাসের মহত্তম অর্জন হচ্ছে ১৯৭১ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ যে চরম মূল্য দিয়েছে বিশ্বের অন্য কোনও জাতিকে তা দিতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসররা ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার কথা বলে স্মরণকালের নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয়ের এক বছরেরও কম সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীরা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান; যেখানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পাশাপাশি তাঁরা ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, ধর্মের নামে হত্যা সন্ত্রাস ও নির্যাতন বন্ধের পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তার প্রধান সহযোগীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার পাশাপাশি ধর্মের নামে রাজনীতি, হত্যা ও সন্ত্রাসের যে বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিলেন, তার বিষফল আজও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী অপশক্তিকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে নির্মূল করার শপথ নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের বিজয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘যে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে আমরা বিজয় অর্জন করেছি, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য ১ ডিসেম্বর ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ ঘোষণার জন্য নির্মূল কমিটি এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা দীর্ঘকাল ধরে দাবি করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে আজও এই দাবি পুনর্ব্যক্ত করছি।’
প্রধান অতিথির ভাষণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রাক্তন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম বলেন, ‘ডিসেম্বর মাস যেমন আনন্দের মাস তেমনি বেদনারও মাস। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে আমরা যেমন বিজয় অর্জন করেছি তেমনি হারিয়েছি আমাদের সূর্যসন্তান ও বুদ্ধিজীবীদের।’
পহেলা ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক মায়া আরো বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা কখনো মারা যান না। তাদের অর্জন কখনো ম্লান হতে পারে না। বাংলাদেশের বিজয় ৫০ বছর অতিক্রম করলেও এই পুরো সময়টি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্বপক্ষের মানুষেরা স্বাধীন ছিল না। কেননা, গত ৫০ বছরে অধিকাংশ সময় স্বাধীনতার বিরোধী চক্র বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ’৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচার করে আজ বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যার সঙ্গে আছি।’
নির্মূল কমিটি ও উপস্থিত সকল বক্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘পহেলা ডিসেম্বর আমাদের নতুন করে একাত্তরকে মনে করিয়ে দেয়। আমরা একাত্তরের পরাজিত শক্তি রাজাকার আলবদরদের আর ক্ষমতায় দেখতে চাই না। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা সবসময় সংগঠিত হয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। তাদের সেই অপচেষ্টাকে আমাদের যেকোনো কিছুর বিনিময়ে রুখতে হবে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে তারা কোনদিন সফল হতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানি চক্র যখন বাংলাদেশকে দখলে নেয়ার প্রচেষ্টা করেছিল তখনও আমরা লড়াই করেছি এবং সে লড়াই এখনো অব্যাহত আছে। আমরা বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় বিজয়কে ক্ষুন্ন হতে দেব না। আজও পাকিস্তান তাদের পরাজয় মানতে না পেরে ক্রিকেট খেলাকে অবলম্বন করে তাদের পতাকা বাংলাদেশে ওড়ানোর অপচেষ্টা করছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম তা হতে দেয়নি। আমরা অতীতেও তাদের ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব।’
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যেন আর কখনো বাংলাদেশের ক্ষমতায় না আসতে পারে সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ বলেন, ‘২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা খবর পেয়েছি রাস্তার মানুষের কাছে। এরপর আমরা নিজ উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। আমি দেখেছি রাস্তায় রাস্তায় মিছিল মিটিং হচ্ছে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর পর আমরা খবর পেলাম চট্টগ্রামের সেনানিবাসে বাঙালি সেনাদেরকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করছে, ইত্যবসরে আমি একজন গৃহবধু হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকা ও রসদ সংগ্রহের কাজ করেছিলাম। এভাবেই আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আজ আমরা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদলকারী দল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। ভবিষ্যতেও যেন এ ধারা অব্যাহত থাকে।’
একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে মানবাধিকার নেত্রী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবির বলেন, ‘ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু এমন এক নেতা ছিলেন যার তুলনা তিনি নিজেই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাটি মেজর জিয়াকে দিয়ে পাঠ করানো হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রণিত বাহাত্তরের সংবিধানকে জেনারেল জিয়া, এরশাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা বারবার পরিবর্তন করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে হত্যা করে। আজ কিছু চক্র বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে হেয় করে বলে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ভারতের মতো করে ঢেলে সাজাতে হবে। আমি তাদেরকে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ না করলে এদেশের কোন কিছুই পছন্দ হবে না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করেই বাংলাদেশকে পরিবর্তন করতে আসতে হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এটা শুধু দুই দেশের যুদ্ধ ছিল না। যে যুদ্ধে গেরিলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত নারী গেরিলারা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভ‚মিকা কোনো অংশেই কম নয়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান অবদান রেখে চলেছেন।’
প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করলেও বাংলাদেশ আজও পূর্ণাঙ্গভাবে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হতে পারেনি। কারণ একাত্তরের ঘাতকরা বাংলাদেশ আজও সক্রিয়। অন্যদিকে, আমরা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারিনি, পারিনি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন করতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখন সাইবার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা অনলাইনে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। অন্যদিকে তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে বিভ্রান্ত হচ্ছে। আমাদের সম্মিলিত হবে সাইবার যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। আর এই যুদ্ধে আমাদের প্রধান অস্ত্র হবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি, মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা, বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি, বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি কাজগুলো সঠিক ভাবে প্রণয়নের মাধ্যমেই আমরা সাইবার জিহাদিদের বিপক্ষে জয় লাভে সক্ষম হব।’
সভাপতির বক্তব্যে সাংবাদিক শওকত বাঙালি বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করার প্রথম দিন। ২৪ বছরের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। প্রভাত সূর্যের রক্তাভা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন।’
তিনি আরোও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধদের সম্মান জানানোর জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তৈরির জন্যই ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এবং এটি মুক্তিযুদ্ধের আপামর জনতার দাবি।’
সভার অন্যান্য বক্তাও ১ ডিসেম্বর ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ হিসেবে সরকারিভাবে পালনের দাবি জানান।