ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:৩৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৭৯ বার
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। অর্থনীতির নিয়ামক হিসাবে অন্য সূচকগুলো গতিশীল হচ্ছে। কিন্তু নেতিবাচক ধারা বইছে প্রবাসী আয়ে। ক্রমান্বয়ে কমছে এ খাতের আয়। ধারাবাহিক এ বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়াতে বিদ্যমান প্রণোদনার হার আরও বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
রেমিট্যান্স কমার পেছনে প্রাথমিকভাবে তিনটি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। প্রথমত, করোনায় বিদেশ ফেরত কর্মীর চেয়ে বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা কমছে। দ্বিতীয়ত, ইন্টার ব্যাংকিং থেকে কার্ব মার্কেটে (খোলাবাজারে) ডলারের মূল্য ব্যবধান বেশি, তৃতীয়ত, করোনা-পরবর্তী হুন্ডি ব্যবসা সক্রিয়।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিলের সভায়ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সভা হয়। সেখানে দেখানো হয়, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে গতি ফিরলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্স খাতে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ খাতে বিদ্যমান প্রণোদনা আরও বাড়ানোর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত বর্তমান রেমিট্যান্স খাতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে ২ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে একশ টাকা পাঠালে দেওয়া হচ্ছে ১০২ টাকা। এতে প্রণোদনা বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে সরকারের। নতুন করে আরও ২ শতাংশ প্রণোদনা বাড়ানো হলে এ খাতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে রেমিট্যান্স বাড়াতে বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানো হয়, সেদিকে বেশি জোর দেওয়ার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেন্স কাউন্সিলের সদস্যরা।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের জন্য বিদ্যমান প্রণোদনার হার আরও বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত সরকার নিতে যাচ্ছে সেটি ভুল। কারণ করোনার মধ্যে আমরা কেউ বিদেশে যেতে পারিনি। বছরে শুধু চিকিৎসার জন্য ১৫ লাখ মানুষ ভারতে যায়। এরপর ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, সিঙ্গাপুরে অনেকে যান। সেখানে যাওয়া বন্ধ ছিল। সাশ্রয়কৃত অর্থ বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্সে যোগ হয়েছে। আবার হুন্ডি ব্যবসা করোনায় বন্ধ থাকায় সবাই বৈধ চ্যানেলে টাকা বিদেশ থেকে পাঠানোর কারণেও রেমিট্যান্স বেড়েছিল। কিন্তু সেটি ছিল ক্ষণস্থায়ী। তিনি বলেন, কার্ব মার্কেট ও ইন্টার ব্যাংক মার্কেট উভয়ের মধ্যে এক মার্কিন ডলারের মূল্য পার্থক্য ৬ টাকা। যা কখনো হয়নি। এই ব্যবধান যত বাড়বে ততই রেমিট্যান্স কমবে। সরকারকে ইন্টার ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটের ব্যবধান কাছাকাছি জায়গা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বৈধ আর অবৈধ যেটা বলি হন্ডির মাধ্যমে মানুষ টাকা পাঠাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর এই পাঁচ মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আসছে ৮৬১ কোটি মার্কিন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৯০ কোটি ডলার। অর্থাৎ এই পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স আসার অঙ্ক কমছে ২২৯ কোটি ডলার বা ১৯ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত নভেম্বর মাসে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যা বিগত ১৮ মাসের সর্বনিম্ন। নভেম্বরে ১৫৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এটি অক্টোবর মাসের তুলনায় ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম। সেই সঙ্গে এটি গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ বা ৫২ কোটি ৫০ লাখ ডলার কম। গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।
জানা গেছে, খাদ্যপণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের টিকার পেমেন্ট শোধ করতে হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতির তীব্রতা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কমে আসায় বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হচ্ছে, যে কারণে মানুষ বিদেশ ভ্রমণে বেশি যাচ্ছে। এর সঙ্গে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আনুষ্ঠানিক বিনিময় হারের তুলনায় খোলাবাজারে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য বেশি। এ কারণে ব্যাংকের মাধ্যমে অনেক প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য ৯২ টাকা। অথচ ব্যাংকে তা ৮৫.৮০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। দুই ক্ষেত্রে বিনিময় হারের বড় পার্থক্যেও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমার বড় কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স কমছে প্রায় ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মার্কিন ডলার, কুয়েত থেকে ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার, আরব আমিরাত থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার কমেছে। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে ৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার, ওমান থেকে প্রায় ২৯ কোটি ডলার এবং অন্যান্য দেশ থেকে কমছে প্রায় ২০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স নিয়ে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২১ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি কমবে। সংস্থাটি আরও বলেছে, চলতি বছরের ৯ মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি মন্থর ছিল। যা ২০২২ সালের জন্য নিম্নমুখী ঝুঁকির ইঙ্গিত। তবে বাংলাদেশের অভিবাসীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এমনটা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ২০২০ সালে ৪ লাখ ৮ হাজার ৪০৪ জন প্রবাসী ফেরত আসে। এর মধ্যে অনেক কর্মী নতুন করে আর বিদেশে যায়নি।
সূত্র : যুগান্তর