ঢাকা, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

মেঘ-পাহাড়ের মিতালী সাজেক

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:৪২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৯৫ বার


মেঘ-পাহাড়ের মিতালী সাজেক

ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে সাজেক উপত্যকা বা সাজেক ভ্যালি এখন ভীষণ জনপ্রিয় এক নাম। সময় সুযোগ পেলেই পাহাড়ের অপূর্ব রূপ দেখার জন্য ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে যান সাজেকে। এখানে মেঘে আচ্ছন্ন পাহাড়-গিরি দেখার আনন্দ-ই আলাদা।

মেঘ আর পাহাড়ের অপরূপতায় সাজেক ভীষণ মোহাবিষ্ট করেছে পর্যটকদের। শীত ঋতুতে ছুটি কাটাতে প্রতিদিন তাই ছুটে চলেছে ভ্রমণপিপাসুরা।

পর্যটকদের আনাগোণায় মুখরিত এখন সাজেক। ভারতের মিজোরাম রাজ্য ঘেষা সাজেক ভ্যালির চারপাশে শত পাহাড়ের বিনুনি। চারদিকে উঁচু-নিচু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের ছড়া আর ঝিরি ছড়িয়ে আছে চারদিকে। দুচোখের বিস্তৃত সীমানায় পাহাড় আর মেঘ ছাড়া এখানে কিছইু নেই।

সারাদিন মেঘের সাথে পাহাড় এখানে খেলা করে। প্রকৃতি রাজ্যে পাহাড়-মেঘের মিতালীর এই অপরুপতা তুলনাহীন। সকালে কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় নিচে দূরের পাহাড়গুলো সাদা মেঘের ভীড়ে হারিয়ে গেছে। সকালে সূর্য ওঠার দৃশ্যটাও এখানে অসাধারণ লাগে। বিষন্ন নিরবতার মাঝে পাহাড়ের বুক চিড়ে ওঠে আসে সূর্য।

সাজেক ভ্যালি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি স্থান। সাজেক ইউনিয়নের উত্তরের শেষ সীমানার অংশটিই সাজেক ভ্যালি। ইউনিয়নের নামেই ভ্যালির নাম বিস্তৃত। বাঘাইছড়ি উপজেলাতে রয়েছে মোট আটটি ইউনিয়ন। ইউনিয়নগুলো হলো- বাঘাইছড়ি সদর, আমতলী, খেদারপাড়া, মারিশ্যা, বঙ্গলতলী, রুপকারি, সার্বোয়াতলী এবং সাজেক। এটি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন ইউনিয়ন হলেও এখানে যাতায়াতের পথ খাগড়াছড়ি জেলা সদর হয়ে। খাগড়াছড়ি সদর থেকে সাজেক ভ্যালির দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা, বাঘাইঘাট হয়ে সাজেক ভ্যালিতে যেতে হয়। পুরোটাই পাহাড়ি পথ। সাজেকে যাওয়া আসা নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় সেনা ও পুলিশ ক্যাম্প।

কয়েকবছর আগেও সাজেকে সেভাবে পর্যটকরা সহজে যেতে পারতেন না। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত স্বল্পতা আর পানি সংকটের কারণে সেখানে যেতে উৎসাহিত হতেন না কেউ। কিন্তু এখন নিরাপদ রাস্তা আর বিদ্যুৎ সুবিধার কারণে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে ভীষণ রকম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাজেক ভ্যালি। শীত, বর্ষা সব সময়ই এখন পর্যটকে ভরপুর থাকে সাজেক। এক এক ঋতুতে সাজেকের রুপবৈচিত্র্যও একেকরকম। আর বছরের শেষে সাজেক পর্যটকদের আগমনে পুরোপুরি মুখরিত হয়ে ওঠে। বর্ষা বা শীতে সাজেকের রুপবৈচিত্র্য ভিন্ন বলে অনেকেই দু মৌসুমেই এখানে বেড়াতে আগ্রহ বোধ করেন।

অনেকের মতে শীতের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে সাজেক নাকি আরও নয়নাভিরাম লাগে। খাগড়াছড়ি এবং সাজেকের মাঝখানে ১০ নং বাঘাইঘাট পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প সাজেকের সমস্ত পর্যটকদের যাওয়া-আসা নিয়ন্ত্রণ করে। ‘আর্মি এসকর্ট’ দিয়ে এখানে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাক্যাম্পের অনুমতি ছাড়া এ পথে যাওয়া-আসা করা যায় না, সেটা ঠিকও না। সাজেকে যাওয়ার প্রধান উপায় ‘চাঁন্দের গাড়ি’। এটি বিশেষ ধরনের জীপ। পাহাড়ের উচুঁ-নিচু পথে এই জীপগুলো নিরাপদ।

সাজেক ভ্যালির মূল আকর্ষণ উঁচু-নিচু পাহাড় আর মেঘ। সাথে বনরাজিতো রয়েছেই। পাহাড় আর মেঘের অপূর্ব খেলা দেখার আকর্ষণেই পর্যটকরা ছুটে চলেন সাজেকে। দুটি নৃ-গোষ্ঠী পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত সাজেক ভ্যালি । পাড়া দুটি হলো রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়া। ভ্যালির শুরুতেই রুইলুই পাড়া। আর শেষ দিকটাতে কংলাক পাড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে রুইলুই পাড়ার উচ্চতা ১৭০০ ফিট। আর কংলাক পাহাড়ের চ‚ড়োর উচ্চতা ১৮০০ ফিট। এ দুটি পাহাড়ের আনাচে কানাচে আদিবাসিন্দা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী লুসাই আর ত্রিপুরাদের বসবাস। পাহাড়ের মাথায় এ এক অসাধারণ জনবসতি। এদের স্বল্প  সান্নিধ্য হৃদয়ে অন্যরকম অনুরণন তোলে। সাজেক ভ্যালির শেষ গ্রাম কংলাক। কংলাক আসলে সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়া।

সাজেক বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরত্বের রাস্তা কংলাক। কংলাক পাহাড়ের আগে রয়েছে বিজেবি ক্যাম্প এবং হেলিপ্যাড। ওখান থেকে ২০ বা ২৫ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাকপাড়া যাওয়া যায়। এই পাড়া থেকে মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত খুব বেশি দূর নয়। পাহাড়ি বিভিন্ন পথে ঘণ্টা দুয়েক হেঁটেই যাওয়া যায়। তবে এখানকার পথগুলো খুবই দুর্গম। মজাটা হলো পর্যটকরা সবাই-ই হেঁটে হেঁটে কংলাক পাহাড়ের চূঁড়াতে উঠেন। সাজেকে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী লুসাই এবং ত্রিপুরাদের প্রধান পেশা জুম চাষ। এ ছাড়া হলুদ, আদা, কমলার চাষ হয় এখানে। কংলাক পাহাড়ে বসবাসরত লুসাই পরিবারগুলো পর্যটকদের জন্য অবশ্যই বাড়তি আনন্দ। এখানে যারা ঘুরতে আসেন তারা একবার হলেও লুসাই পল্লীতে যান। ওদের সাথে ছবি তোলেন।

সাজেকে থাকার জন্য প্রচুর রিসোর্ট, গেস্ট হাউস গড়ে উঠেছে। এসব রিসোর্টগুলোর নামও সুন্দর। মেঘপুঞ্জি, হিলকটেজ, মেঘমালা, মেঘাদ্রি, টংথক, লুসাই, কাশবন, নীলপাহাড়ি-এরকম অনেক রিসোর্ট রয়েছে। এখানে বেশিরভাগই কটেজ বা রিসোর্ট কাঠ, খড় দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি। ভ্যালির মূল রাস্তার দুপাশ জুড়েই রয়েছে রিসোর্টগুলো। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার জন্য যে যার পছন্দমতো রিসোর্ট বেছে নেন। যারা রাস্তার ডান পাশের রিসোর্ট বা কটেজে ওঠেন তার পাহাড়-আকাশ ও মেঘের চমৎকার ভিউ-এর সাথে সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পান। অনেকেই তাই মেঘপুঞ্জি, লুসাই, টংথক রিসোর্ট-এ থাকার জন্য বেছে নেন।

সাজেক ভ্যালিতে থাকার জায়গাগুলো যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি খাবারও। খাবারগুলো পর্যটকদের অভিভূত না করে পারে না। বিশেষ করে বেম্বো চিকেন এবং বেম্বো টি এখানে বাড়তি আকর্ষণ। বেম্বো চিকেন পাহাড়ি বাঁশের মধ্যে মশলা-চিকেন একসাথে মাখিয়ে দিয়ে আগুনে বাঁশ পুড়িয়ে বিশেষভাবে রান্না করা হয়। বেম্বো চিকেনের স্বাদ একটু ভিন্ন। স্বাদে-গন্ধে অবশ্যই বৈচিত্র্যময়। একইভাবে বেম্বো টি পান না করলে সাজেক ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। তবে সাজেক ভ্রমণে কংলাক পাহাড়ে ওঠার আনন্দটা অন্যরকম। আকাঁ-বাকা বিভিন্ন পথ ধরে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চূড়াতে উঠতে হয়। যত কষ্টই হোক সবাই পাহাড়ের চূড়াতে পৌঁছাতে দ্বিধা করেন না। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য কম বেশি সবাই লাঠির সহযোগিতা নেন।

আপনিও যেতে পারেন আমাদের দেশের এই মনোরম স্থানে। পাহাড়ি পথ বেয়ে বেয়ে যখন সাজেকে পৌঁছাবেন তখন সত্যিই হ্নদয়ে অন্যরকম এক আনন্দ অনুভূত হবে। তবে এখানে যাওয়ার আগে সবকিছু ঠিকঠাক করে যাওয়া ভাল। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর রয়েছে তাদের ব্যবস্থাপনায় গেলে অনেকসময় বাঁচবে। ঘুরেও আনন্দ পাবেন বেশি।


   আরও সংবাদ