ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

বিমা খাতের কলঙ্কের বছর

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৩ জানুয়ারী, ২০২২ ১৭:০৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫২৭ বার


বিমা খাতের কলঙ্কের বছর

গ্রাহকের আমানত লোপাট এবং বিমা দাবি পরিশোধে অনীহার কারণে এমনিতেই আস্থা সংকটে বিমা খাত। তার সঙ্গে ২০২১ সাল জুড়ে আলোচনায় ছিল বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ। যা বিমা খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায়। আর তাতে বিমা খাতের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির পরিবর্তে আস্থা কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডেল্টা লাইফের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম

বিশ্বব্যাপী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যদিয়ে শুরু হয় ২০২১ সাল। করোনার কারণে বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ছিল মন্দা। ঠিক এই সময়ে বেরিয়ে আসে ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম।

এর মধ্যে ৩৫ কোটি টাকা রয়েছে শুধু রাজস্ব ফাঁকি। আর বাকি টাকা লোপাট করেছে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। যা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বিশেষ নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। অথচ হাজার হাজার গ্রাহক মেয়াদপূর্তী করেও বছরের পর বছর কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ বুঝে পাচ্ছেন না।

গত বছর ৭ ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডর সাবেক নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কামরুল আহসান ও কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমানসহ একটি টিম, আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন তাদের কাছে দুই কোটি টাকা ঘুষ চেয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ২০১০ সালে আইডিআরএ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কোনো চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইডিআরএর অধীনে থাকা কোম্পানি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করল। এই ঘটনার পর ১ মার্চ আইডিআরএ আয়োজিত জাতীয় বিমা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চেও রাখা হয়নি চেয়ারম্যানকে।

তবে আইডিআরএর চেয়ারম্যান ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করেছেন। এরপর ঘুষের তথ্য তুলে ধরায় প্রতারণার অভিযোগ তুলে ২০০ ধারায় ডেল্টা লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারি মামলা করেছে আইডিআরএ। বিষয়টি অর্থমন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। 

প্রাইম ইনস্যুরেন্সের অর্থপাচার 
এরপর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় অর্থপাচার করেছে প্রাইম ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালকরা অর্থ পাচার ও লোপাট করেছেন। তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন সাবেক এমডি মোহাম্মদী খানম ও ডিএমডি সৈয়দ মনিরুল হক। আইডিআরএ বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে আসে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো শাস্তি দেয়নি।

ফারইস্ট লাইফের গ্রাহকের ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট 
এরপর উঠে আসে গ্রাহকের ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের মালিকরা। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান এমএ খালেক ও নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন পরিচালক মিলে এই অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশে বাড়ি-গাড়ি এবং বিভিন্ন কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। তাতে সহযোগিতা করেছেন সাবেক এমডি হেমায়েত উল্লাহ। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠানটি প্রথম তদন্ত করে সাবেক এমডিকে দায়মুক্তি দেয়। দ্বিতীয় দফায় আবারও তদন্ত করে  এমএ খালেক ও নজরুল ইসলামকে দায়ী করেন। আর এমডি হেমায়েত উল্লাহকে এমডি পদ থেকে অব্যাহতি দেন।

তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদনে অর্থ লোপাট ও পাচারে তথ্য ধরা পড়েছে। 

দুই বিমা কোম্পানি অনুমোদন

শুধু লোপাটের ঘটনাই শেষ নয়, করোনার বছরেও থেমে থাকেনি নতুন কোম্পানির অনুমোদন। ২০২১ সালের ৬ মে দেশে বিমা ব্যবসা করতে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড এবং বীচল্যান্ড ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড নামে দুটি কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে আইডিআরএ। কোম্পানি দুটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের হাতে জীবন বিমা ব্যবসার লাইসেন্স হস্তান্তর করে আইডিআরএ। ফলে বিমা খাতের কোম্পানিগুলাতে অনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও বাড়ার শঙ্কা বিশ্লেষকদের।

কমিশন সিস্টেম চালু
দেশের সকল মানুষকে বিমার আওতায় আনতে জীবন বিমা কোম্পানির এজেন্টদের পলিসির উপর ১৫ শতাংশ হারে কমিশন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু কোম্পানিগুলোর ১৫ শতাংশের কমিশনের আইন ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত করেও কমিশন দিতো এজেন্টদের। এই অনৈতিক চর্চার কারণে মেয়াদপূর্তীর পর গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারত না বিমা কোম্পানিগুলো। 

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোলনের জন্য বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী আইনটি স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু গত নভেম্বর মাসে বর্তমান আইডিআরএ আবারও কমিশন প্রথা চালু করছে। যা বিমা কোম্পানির জন্য অশনি সংকেত। বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, ডেল্টা লাইফ এবং ন্যাশনাল লাইফসহ মোট ৩৪টি জীবন বিমা কোম্পানি দেশে বিমা ব্যবসা করছে।

বিমা কোম্পানির শেয়ার কারসাজি
২০২০ সালের পর ২০২১ সালও পুঁজিবাজারে বছর জুড়ে হয়েছে বিমা খাতের শেয়ার কারসাজি। করোনার কারণে বিদায়ী এই বছরে কোম্পানির কোনো মুনাফা না হলেও শেয়ারের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলোর কাছে কারণ জানতে চেয়েছে। কোম্পানিগুলো জানিয়েছে তাদের কাছে সংবেদনশীল কোনো তথ্য জানা নেই। এরপর একাধিকবার সতর্ক করা হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বরং বছর জুড়েই বেড়েছে সোনালী লাইফ, ডেল্টা লাইফ, এশিয়া ইনস্যুরেন্স, এশিয়ার প্যাসিফিক, নিটোল ইনস্যুরেন্স, ইস্টার্ন ইনস্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্স এবং প্রভাতী ইনস্যুরেন্সের শেয়ার কয়েকগুণ বেড়েছে। হয়েছে কারসাজি। এই শেয়ার কারসাজি চক্রের হোতা হলেন আবুল খায়ের হিরু। তার সঙ্গে ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ এবং ক্রিকেটারও জড়িত রয়েছে। 


   আরও সংবাদ