ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৭ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫০১ বার
বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ডের পরিমাণ ২০১৫ এর পর থেকে স্থবির হয়ে আছে। এই লাইফ ফান্ডেই বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রিমিয়াম জমা রাখে এবং এখান থেকেই বিমার দাবি মেটানো হয়।
স্থবিরতার পেছনে মূল কারণের মধ্যে আছে বিমা দাবির টাকা ঠিকভাবে দেওয়া হবে কিনা সে ব্যাপারে গ্রাহকের আস্থার অভাব, নতুন জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান আসায় বাড়তি প্রতিযোগিতা এবং চলমান করোনা মহামারি।
অনুমোদন পাওয়া ৩৩টি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এই ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ৫টির লাইফ ফান্ড ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ এ কমেছে আর ৬টির লাইফ ফান্ড সামান্য বেড়েছে।
এদিকে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা তেমন ভালো না থাকলেও, গত দুই বছর ধরে বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম বাড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন জানান, গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে, যার ফলে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কিন্তু নতুন গ্রাহক সেভাবে বাড়েনি।
যখন বাজার ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, তখনই মহামারি আঘাত হানে, জানান তিনি। এখনো বিমা খাতে সার্বিকভাবে ডিজিটাল প্রক্রিয়া অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি এবং এখনো সরাসরি গিয়েই পলিসি খোলার ব্যাপারে কাজ করতে হয়, যোগ করেন কবির।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে নীতিমালায় বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান কবির হোসেন আরও বলেন, 'আমরা আশাবাদী ব্যবসা আরও ভালো হবে।'
আইডিআরএ'র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০টি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো--আলফা ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্স, আস্থা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, ডায়মন্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, গার্ডিয়ান লাইফ ইনস্যুরেন্স, যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, এলআইসি বাংলাদেশ, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, স্বদেশ লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইনস্যুরেন্স ও আকিজ তাকাফুল লাইফ ইনস্যুরেন্স।
আইডিআরএ'র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র এসএম শাকিল আখতার জানান, কিছু প্রতিষ্ঠান মেয়াদ পূর্ণ হওয়া পলিসি ও মৃত্যুজনিত বিমা দাবি পূরণ না করায় সার্বিকভাবে এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে।
২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠানের লাইফ ফান্ড মাত্র ২ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ৫৭০ কোটি হয়েছে।
কিন্তু এর আগে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই তহবিলের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ১২৩ কোটি হয়েছিল।
এই বিশ্লেষণে ২০২০ এর তথ্য নেই, কারণ ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্স এখনো তাদের ২০২০ সালের তথ্য প্রকাশ করেনি।
আখতার জানান, ৮ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠান তহবিল তছরুপ করেছে এবং গ্রাহকদের যৌক্তিক বিমা দাবি মেটাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এদিকে নতুন গ্রাহক না বাড়লেও অনেক কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খরচ বাড়িয়ে ফেলেছে।
'যখন মানুষের আস্থা চলে যায়, তখন ব্যবসার ওপর প্রভাব পড়ে', যোগ করেন তিনি।
সব নিয়ম মেনে চলে এরকম কিছু বিমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বাড়ছে, কিন্তু তারাও তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারছেন না।
আখতার জানান, আস্থা কম থাকার কারণে বিমার প্রসার কমে যাচ্ছে, যা এমনিতেই অনেক কম ছিল।
সুইস রে ইন্সটিটিউটের দ্য সিগমা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশে বিমা ব্যবহারের হার ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ আর এর এক বছর আগে এই হার ছিল শূন্য দশমিক ৪৯, যেটি উদীয়মান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই হার ২০২০ সালে ৪ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
আখতার জানান, এই খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বড় ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন এবং আইডিআরএ সেই চেষ্টাই করছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন একটি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ২০১৫ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে কিছু বিমা প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকাণ্ড সবার সামনে আসে, যেটি এই খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সম্ভাব্য গ্রাহকরা সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন আর যাদের পুরনো পলিসি ছিল, তাদের অনেকেই সেগুলো বন্ধ করে দেন, জানান তিনি। বাংলাদেশে কম মানুষ বিমার গ্রাহক হওয়ায় এই খাতে প্রবৃদ্ধির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, তবে আস্থাহীনতার কারণে ইতোমধ্যে বাজারের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'সমস্যা হচ্ছে, নতুন গ্রাহক তৈরির প্রক্রিয়াটি প্রায় স্থবির অবস্থায় আছে। অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি কোনো দিক দিয়ে ভালো নয়।'
তিনি যোগ করেন, 'যেভাবেই হোক না কেন, আইডিআরএকে আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করতে হবে। অথবা এই খাতের প্রবৃদ্ধি হবে না।'
২০১৫ থেকে ২০২০ এর মধ্যে সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লাইফ ফান্ড ৩৪৪ কোটি টাকা থেকে কমে ১৮২ কোটি হয়েছে।
কোম্পানিটির চেয়ারপার্সন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ বলেন, 'আমাদেরকে অসংখ্য বিমার দাবি মেটাতে হয়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী নতুন গ্রাহকের সংখ্যা কম ছিল।'
তিনি জানান, গত ৪-৫ বছরে অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান এসেছে, কিন্তু নতুন গ্রাহক সেভাবে আসেনি। ফলে প্রতিযোগিতা বেড়েছে।
এ কারণে প্রিমিয়াম থেকে আয় কমেছে, জানান তিনি। ২০২০ এ লাইফ ফান্ড কমার হার এর আগের বছরের তুলনায় কম ছিল, যোগ করেন রুবিনা।
তিনি আগামীতে আরও ভালো দিন দেখার আশাবাদ প্রকাশ করেন।
ইতোমধ্যে, পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লাইফ ফান্ড ৩৮ শতাংশ কমে ১ হাজার ৭৫৮ কোটি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির সচিব মোস্তফা হেলাল কবির জানান, প্রায় ২০ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এ কারণে তাদেরকে এখন অনেক দাবি মেটাতে হচ্ছে, যার ফলে লাইফ ফান্ড কমে আসছে, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'প্রকৃতপক্ষে, বাজারের পরিস্থিতি ভালো নয়।' তিনি আরও জানান, যখন তারা ব্যবসা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন, তখন মহামারি আঘাত হানে। 'এখন আমরা অনেক চেষ্টা করছি', যোগ করেন তিনি।
একই সময়ে, ফারইস্ট ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লাইফ ফান্ড ২১ শতাংশ কমে ২ হাজার ৪৭৪ কোটিতে নেমেছে। এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সিইও মোহাম্মদ আলমগীর কবিরকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। তিনি মেসেজেরও উত্তর দেননি।
ইতোমধ্যে পদ্মা লাইফ ইনস্যুরেন্সের লাইফ ফান্ড ৯৬ শতাংশ কমে ১৩ কোটিতে নেমেছে। কোম্পানি সেক্রেটারি সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
একই সময়ে সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লাইফ ফান্ড ১২ শতাংশ কমে ৭৯৭ কোটিতে নেমেছে।
প্রিমিয়াম থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বিমা দাবির পরিমাণ বেশি হওয়ায় লাইফ ফান্ড কমে যাচ্ছে বলে যুক্তি দেন সন্ধানীর সিইও নিমাই কুমার সাহা। 'তবে এর মাধ্যমে আমাদের লায়াবিলিটি কমছে', যোগ করেন তিনি।
তিনি দুঃখ করেন, ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি খুব একটা ভাল হয়নি, কারণ কিছু বিমা প্রতিষ্ঠান নিয়ম অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেননি। সার্বিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো খাতের ওপর। 'আমাদের ব্যবসা এখন বাড়ছে', যোগ করেন তিনি।
গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের মূল্য ৮০ শতাংশ বেড়ে ৩৬ টাকা হয়েছে।
পদ্মা লাইফ ইনস্যুরেন্সের শেয়ারের মূল্য ১৯৩ শতাংশ বেড়ে ৫১ টাকা, সানলাইফের ৯৫ শতাংশ বেড়ে ৩৯ টাকা, ফারইস্ট ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্সের ৫৬ শতাংশ বাড়ে এবং পপুলার লাইফের শেয়ারের মূল্য সামান্য বেড়ে ৮৫ টাকায় পৌঁছায়।