ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৭ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৯৫ বার
এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব হওয়ার কারণেই মূলত এটি আদায়ে তেমন আগ্রহ নেই ভ্যাট কর্মকর্তাদের-এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। তাদের আশঙ্কা-এতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সরকারের এ মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে।
হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের আইবাস প্লাস প্লাস ডেটাবেজের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ আদায় হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা।
২০১৮-১৯-এ হয়েছে ৯৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জমা পড়েছে ৯৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১ লাখ ৮৯ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে সিলেট, বগুড়া, রংপুর ও ঢাকা ভ্যাট কমিশনারেট থেকে।
একাধিক ভ্যাট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ এনবিআর-বহির্ভূত কর হওয়ায় এটি আদায়ে আগ্রহ কম থাকে। কারণ একজন কর্মকর্তার সাফল্য হিসাবে শুধু তার ওপর অর্পিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকেই ধরা হয়। এর বাইরে অন্য কর্মকাণ্ড আমলে নেওয়া হয় না। শুধু রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আদায়ের ওপর ভর করে কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স বিবেচনা করা হয়। যেহেতু পরিবেশ সারচার্জ এনবিআর-এর রাজস্ব আদায়ের মধ্যে পড়ে না তাই এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যা জমা দেয়, তাই জমা নেওয়া হয়। এ বিষয়ে আলাদা মনিটরিং করা হয় না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জের কাছাকাছি সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়ন সারচার্জ ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা হয়। মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়ন সারচার্জ আদায় করা হয়। আর স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আদায় করা হয় সিগারেট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। এ দুটি সারচার্জ নিয়মমাফিক আদায় করা হলেও পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ আদায়ে ভ্যাট অফিসগুলো একেবারেই উদাসীন। প্রতিমাসে এনবিআর-এ পরিবেশ সারচার্জ আদায়ের তথ্য পাঠানোর নিয়ম থাকলেও ভ্যাট অফিসগুলো তা মানছে না।
এনবিআর-এর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের পর পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান তালিকা থেকে বের হওয়ার আবেদন করেছে। যেহেতু তালিকা পরিবেশ অধিদপ্তর করেছে, তাই এনবিআর-এর এক্ষেত্রে করার কিছু নেই।
সারা দেশের ভ্যাট আদায় কার্যক্রম মনিটরিং করে এনবিআর-এর মূসক বাস্তবায়ন শাখা। এ অনুবিভাগের সদস্য আব্দুল মান্নান শিকদারের কাছে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ২২ ডিসেম্বর বলেন, ‘এ বিষয়ে জেনে জানাতে হবে।’
একই সঙ্গে তিনি মূসক নীতি শাখায় এ ব্যাপারে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর মূসক নীতি অনুবিভাগের সদস্য মাসুদ সাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ২০১৫ সালের পর পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জের তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। এটা পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ আরোপ করা হয়। মূলত দেশীয় শিল্পের যেসব খাত পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, সেসব শিল্পমালিককে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার অংশ হিসাবে পরিবেশহানিকর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের ওপর মূল্যভিত্তিক ১ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা হয়। এ পদক্ষেপটি ওই সময়ে পরিবেশবাদী সব সংগঠনের প্রশংসা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৩০ জুন এবং পরে ২০১৭ সালে সারচার্জ আদায় বিধিমালা জারি করা হয়। এরপর পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও এনবিআর-এর মধ্যে বহু চিঠি চালাচালি হয়। পরে ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ দূষণকারী ৭৫৭টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়।
হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-১০ অর্থবছরের সারচার্জ আদায় হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা টাকা। অর্থাৎ দূষণকারী ৭৫৭টি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ১০৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে গড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর টার্নওভার দাঁড়ায় মাত্র ১৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। আর অজ্ঞাত কারণে সারচার্জের বিষয়ে নিশ্চুপ পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিবছর দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করার কথা থাকলেও ২০১৫ সালের পর আর নতুন তালিকা তৈরি করা হয়নি। এমনকি এ সারচার্জের অর্থের বিষয়ে সরকারকে কোনো সুপারিশও করেনি।
পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা বলছেন, পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ নিয়মমাফিক আদায় না করায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের শুধরাচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর নামকাওয়াস্তে বছরে দু-একটি অভিযান চালালেও আর্থিক দণ্ড খুবই সামান্য দেওয়া হয়। তাই প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ দূষণ করেই যাচ্ছে। এছাড়া ২০১৭ সালে পরিবেশ দূষণকারী ৭৫৭টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়, সেখানেও গলদ আছে। প্রতিবছরই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।
তাদের মতে, পরিবেশ দূষণ বন্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বছর যেসব প্রতিষ্ঠান সারচার্জ দেবে তারা তৃতীয় বছর দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকলে জেল-জরিমানা এমনকি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো উদ্যোগ নিলে দূষণ অনেক কমে আসবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মহাসচিব শরীফ জামিল বলেন, এনবিআর-বহির্ভূত কর হওয়ায় পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ আদায়ে এনবিআর-এর ঢিলামি আছে। এক্ষেত্রে এনবিআর-এর আরও তৎপর হওয়া উচিত। শুধু এনবিআর নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যসব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় এদিকে সংশ্লিষ্ট সবার নজর দেওয়া উচিত।