ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

নারী-শিশুর অধিকার রক্ষায় আইন আছে, প্রয়োজন সচেতনতা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১০ জানুয়ারী, ২০২২ ১৮:৫৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৮৬ বার


নারী-শিশুর অধিকার রক্ষায় আইন আছে, প্রয়োজন সচেতনতা

সাংবিধানিক ভাবে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, নারী শিক্ষা ও তাদের ক্ষমতায়নে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশে^ রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রচেষ্টা, সময় উপযোগী ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই আজ সর্বক্ষেত্রে নারীর ইতিবাচক অবস্থান তৈরি হয়েছে। 
স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনীতির সকল সূচকে, মানবিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীদের ভূূমিকা ও অবদান অবিস্বরণীয়। দেশের কৃষি, গ্রামীন অর্থনীতি, পোশাক শিল্প, উন্নয়ন, অগ্রগতিসহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানের ঈর্ষনীয় সাফল্যেও ক্ষেত্রেও নারীরা রেখেছেন অনন্য অবদান। 
কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীদের সর্বত্র সাহসী বিচরণ সত্বেও নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন, সহিংসতার ঘটনায় নারীর অগ্রযাত্রা যেন কুসুমাস্তীর্ন না হয়ে পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
ঘরে, বাইরে মর্যাদার জায়গায় নারীর অবস্থান আশানুরূপ ভাবে পাল্টায়নি; পাল্টায়নি নারীর প্রতি এক শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণেই, দুই বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা নারী সবাই শিকার হচ্ছে সহিংসতার।  
 সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি এবং নারীশিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া সত্ত্বেও আইনের ফাঁক গলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করার আগেই শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ছে তারা। নির্যাতনের শিকার হলেও ‘আইন’ না জানায় প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বেশিরভাগ নারী। এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিতেও পাচ্ছেন না তাদের ন্যার্য অধিকার। এজন্য সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং সম্মিলিত উদ্যোগ।
অথচ নারী শিশু নির্যাতন, বাল্য বিয়ে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রয়েছে আইন। অনেক সময় জনসচেতনতার অভাবে, আবার কখনো কখনো লোকলজ্জার ভয়ে, কখনো অর্থাভাবে, কখনো প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আইনী প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দেয়। আবার কখনো আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা না থাকায় বিচার প্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আইন করার পর 'রিভিউ' বা 'প্রিভিউ' করার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, আইন সম্পর্কে ধারনার অভাবের কারণে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে অধিকার পাচ্ছে না। বিশেষ করে রাস্তা ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মস্থানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে বিধিমালা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। 
  নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); যৌতুক নিরোধ আইন, ১৯৮০; অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ প্রভৃতি।
 মূলত: আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে অনেক নারী প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর কাছে যাচ্ছে না। আবার এ আইনের কয়েকটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণ করতে গেলে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীকেই ভোগান্তি পোহাতে হয়। 
তাই, অনেকে জানলেও মামলা করেন না। এ আইন সম্পর্কে আদালত সংশ্নিষ্টদের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। অথচ আইনটি নারীর একটি শক্তিশালী রক্ষাকবচ হতে পারতো। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধন ২০০৩)-এর অধীনে মামলাগুলোর তদন্ত অনেক সময়ে সঠিক সময়ে হচ্ছে না। বিচারকার্য ১৮০ দিনের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও এতে সময় লাগছে ৩-৬ বছর পর্যন্ত। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসামিকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ২০২০ সালের অক্টোবরে সরকার প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করেছে। সংশোধিত আইনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তবু, ধর্ষণ থামছে না। ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যার মতো অপরাধ কমাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কার্যকর প্রয়োগের লক্ষ্যে উচ্চ আদালত ঘোষিত ছয় দফা নির্দেশনাও প্রায় ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে।
একজন আইনজীবী বলেন, শুধু আইন পরিবর্তন করে অপরাধ দমন করা যায় না। যে আইন আছে তার খুব কার্যকর প্রয়োগ দরকার। ধর্ষণ মামলায় সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ হারটা যদি ৯৭ শতাংশ হতো, তাহলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না। একইভাবে ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে ট্রাইব্যুনালের কাছে তার কারণ লিপিবদ্ধ করে আজ পর্যন্ত সংশ্নিষ্ট বিচারককে কোনো প্রতিবেদন দিতে দেখা যায়নি। পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্নিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ পড়েনি। এ বিষয়গুলো মনিটরিংও করা হয় না। ফলে, অপরাধীরা পার পেয়ে যায় সহজেই। আবার ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে যৌতুক নিলে পাঁচ বছরের কারাদন্ডের কথা বলা হয়েছে। তবে, এখন যৌতুকের ধরন বদলেছে। যৌতুক টিকে আছে 'উপহার' হিসেবে। একইভাবে উত্তরাধিকার আইনের অন্যতম বাধা হয়ে আছে ‘এসভিটি অ্যাক্ট ১৯৫০’-এর  সেকশন ১৪৩-বি।
আমরাই পারি’র আইনজীবী ও একজন  উন্নয়ন কর্মী বলেন, ‘নারীদের সুরক্ষায় বেশ কিছু আইন, নীতিমালা ও হাইকোর্টের নিদের্শনা থাকলেও প্রয়োগের অভাবে নারীরা নির্যাতনমুক্ত স্বাধীন জীবন উপভোগ করতে পারছেন না। নারীদের সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য কিছু আইন থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, পদ্ধতিগত ও প্রায়োগিক নানা সমস্যায় অধিকাংশ নারী এসব আইনের সুফল ভোগ করতে পারছেন না। কারণ, দেশের সর্বস্তরেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল। যতদিন সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার অর্জিত না হবে; যতদিন নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হবে, ততদিন পর্যন্ত শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের পক্ষে খুবই কঠিন।
আবার অনেক সমসয়ে বিচারের ধীরগতিতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার জট কেবলই বাড়ছে। নারীপক্ষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলায় ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে পাচ্ছে। সাজা হয় মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ আসামির। সারা দেশে সব ধরনের ফৌজদারি অপরাধের বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার পাশাপাশি নারী নির্যাতন সংশ্নিষ্ট মামলার বিচার হতেই বেশি সময় লাগছে।  ফৌজদারি মামলায় গড়ে একটি করে মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলে। অন্যদিকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় প্রতি চারটি মামলার মধ্যে একটি মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলে। 'আইনে যেসব বিধান রয়েছে, সেসব নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এসব আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে দুর্বলতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেয়া এবং সংশ্নিষ্ট মহলের রহস্যজনক নিলিপ্ততা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায়ও নারীরা হয়রানির শিকার হন।
 মামলা পরিচালনার খরচ বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষে মামলা করাই কঠিন হয়ে পড়ে। বাস্তবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন থাকলেও তা সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এসব কারণে নারীরা পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ে মামলা করতে আগ্রহী হন না। আইন সম্পর্কে প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার পাশাপাশি সরকার, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্টদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকাই পারে ঘরে-বাইরে নারী, শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।


   আরও সংবাদ