ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:১২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৯২ বার
পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় আজ সোমবার। উৎসুক মানুষের দৃষ্টি এখন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা আদালতের দিকে। বহুল আলোচিত এ মামলাটির যুক্তিতর্ক শেষ হয় ১২ জানুয়ারি। ওই দিনই আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল রায়ের দিন ঠিক করেন। অবশ্য তখন থেকেই মেজর সিনহার পরিবারসহ ওসি প্রদীপের হাতে ক্রসফায়ার ও নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। মামলার ৬৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, জেরা, আলামত প্রদর্শন, রাসায়নিক পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যুক্তিতর্ক এবং সর্বশেষ উভয় পক্ষের সমাপনী কথার মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম চলে ৮ পর্বে ৪০ কার্যদিবস।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত ৯টার দিকে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর সাবেক চৌকস কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করার পর টেলিফোনে ওসি প্রদীপকে বলেন, ‘একজনকে ডাউন করেছি এবং আরেকজনকে ধরেছি।’ ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে সিনহাকে লাথি মেরে এবং পা দিয়ে গলা চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে সিনহার চরিত্রে কালিমা লেপন করে ইয়াবা মদ গাঁজা উদ্ধারের নামে টেকনাফ থানায় দু’টি এবং রামু থানায় একটিসহ তিনটি মামলা করে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। পরে অবশ্য চিত্র পাল্টাতে থাকে। সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদি হয়ে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতসহ ৯ জনকে আসামি করে কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করলে মামলাটি র্যাবকে তদন্তের আদেশ দেন আদালত। পরে অভিযোগপত্রে আরো ছয়জনকে আসামি করা হয়। মোট ১৫ আসামির মধ্যে ১২ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেও ঘটনার মূলহোতা ওসি প্রদীপসহ তিনজন দেননি।
যেসব আসামি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তারা হচ্ছেন, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো: শাহজাহান, কনস্টেবল মো: রাজীব ও মো: আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো: নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে মামলার বাদি শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
ওসি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ড কামনা : এ দিকে টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে প্রদীপের রোষানলে নির্যাতিত শত শত পরিবারের চাওয়া একটাই প্রদীপ ও তার সহযোগীদের যেন মৃত্যুদণ্ড হয়। শুধু তাই নয়, রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের পর থেকেই বিশেষ প্রার্থনা ও রোজা রেখে ওই দোয়াই করছে টেকনাফের অসংখ্য ভুক্তভোগী পরিবার।
তবে, মামলার বাদি নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের কামনা, প্রধান দুই আসামি প্রদীপ কুমার ও লিয়াকতের সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। বাকি আসামিদের সাজা হোক যার যার অপরাধের ভিত্তিতে। এর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
শারমিন শাহরিয়ার বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক না কেন, অপরাধ করলে কেউ আইন ও সাজার হাত থেকে রেহাই পায় না, এ রায়ের মাধ্যমে সেটিই প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’
সূত্র মতে, প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ ওসি থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার জন্ম দেন। তাতে মারা গেছেন ২০৪ জন। নিহত সবাইকে দেয়া হয়েছে ‘মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা’। স্থানীয়দের মতে, ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ছিলেন নিরীহ। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ‘সন্ত্রাসী তকমা’ দিয়ে একই পরিবারের তিন ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করার অভিযোগ আছে প্রদীপের বিরুদ্ধে। ওই পরিবারের সদস্য মুহাম্মদ আলম বলেন, ‘খুনের শিকার’ তিন ভাইয়ের স্ত্রী এবং এতিম সন্তানরা কামনা করছে তাদের অভিভাবকদের হত্যায় জড়িত ওসি প্রদীপ ও অন্যদের যেন মৃত্যুদণ্ড হয়। এটি নিশ্চিত হতে তারা প্রতি সোম ও শুক্রবার রোজা রেখে তাহাজ্জুদ নামাজসহ বিশেষ প্রার্থনায় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছেন।
তাদের প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তি করে তার তিন ভাইকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে জড়িতদের বেশ কয়েকজন সিনহা হত্যা মামলায় আসামি হয়ে কারাগারে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন টেকনাফের ওসি থাকাকালীন নিজের দুই মেয়েকে প্রদীপ ‘ধর্ষণ’ করেছেন দাবি করে এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, মেজর সিনহা হত্যার রায়ের দিন নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে তিনি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ড কামনা করছেন। এ জন্য তিনি রোজা রাখছেন এবং সালাতুল হাজতের নামাজ আদায় করে যাচ্ছেন। ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে মামলা করলেও এখনো পর্যন্ত মামলার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাননি বলে উল্লেখ করেন এ নারী।
টেকনাফ হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা জাহেদুল ইসলাম জানান, ‘মাদকের তকমা’ দিয়ে তার এলাকায় প্রদীপ ১৬ জনকে হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রায় সবাই নিতান্ত গরিব। এসব পরিবারের সদস্যরা এখন প্রদীপের মৃত্যুদণ্ড কামনা করে আল্লাহর কাছে বিশেষ মুনাজাত করছেন বলে জানতে পেরেছেন তিনি।
প্রদীপের অপকর্মের সংবাদ প্রচার করায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হন কক্সবাজারের সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান। তিনি বলেন, মাফিয়া ইয়াবা কারবারির হয়ে কয়েক শ’ পরিবারকে নির্যাতন করেছে প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। এসব বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করায় আমাকে ঢাকা থেকে ধরে এনে অস্ত্র, বিদেশী মদ ও ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়া হয়। এর আগে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। চোখে মরিচের গুঁড়া দেয়া হয়।
সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা বলেন, ‘আমরা চাই প্রদীপের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হোক। সিনহা হত্যায় তার মৃত্যুদণ্ড হলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের মেম্বার হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার বাবা বখতিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন। বাবাকে অমানবিকভাবে ২০২০ সালের ২৪ জুলাই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। সাথে উখিয়া থানার তৎকালীন ওসি মর্জিনাও ছিলেন। বাড়ি তল্লাশির নামে নগদ টাকা-পয়সা সব লুটে নিয়ে যায় তারা। টেকনাফ নিয়ে গিয়ে বাবাকে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হজ করে এসে অসুস্থ শরীরে বাড়িতেই থাকতেন বাবা। আজ বাবা নেই। আমি আমার বাবার খুনি ওসি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ড কামনা করছি। সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন এমন কাজ আর করতে না পারে সে জন্য একটি পরিচ্ছন্ন আদেশ প্রত্যাশা করছি।