ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৪৭ বার
সুইস ব্যাংকসহ বিদেশী অন্যান্য ব্যাংকে দেশের কারা টাকা রেখেছে, এবার তা জানতে চয়েছেন হাইকোর্ট। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) তা জানাতে বলা হয়েছে।
সেই সাথে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সাথে জড়িত যাদের নাম পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে এসেছে, তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ- সিআইডির তার অগ্রগতিও জানতে চয়েছেন আদালত। আগামী ৬ মার্চের মধ্যে হলফনামা করে এসব প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে সংস্থাগুলোকে।
দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইউ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখে রবিবার এ আদেশ দেন মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রিট আবেদনকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ‘সুসইস ব্যাংক এবং বিদেশি অন্যান্য ব্যাংকে কারা টাকা রেখেছে এ বিষয়ে বিএফআইইউকে বিস্তারিত জানাতে বলেছেন আদালত। আর পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন আগামী ৬ মার্চের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে। আর আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি এই মামলার রুল শুনানি তারিখ রেখেছেন আদালত।’
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২৬ জানুয়ারি কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সাথে জড়িত ৬৯ ব্যক্তি ও সত্তার তালিকা আদালতে দাখিল করে বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ ব্যাংক। পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে এসব ব্যক্তি-সত্তার নাম উঠে এসেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে উঠে আসা ৬৯ ব্যক্তি-সত্তার মধ্যে পানামা পেপারসে ৪৩ ও প্যারাডাইস পেপারসে ২৬ ব্যক্তি-সত্তার নাম রয়েছে।
বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) এবং এফআইইউগুলোর সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম ‘এগমন্ট’ থেকে এই ১০ ব্যক্তি-সত্তার বিষয়ে তথ্য পেয়েছে বলে বিএফআইইউ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই ১০ ব্যক্তি-সত্তার বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে দেশের সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এদিকে বিএফআইইউ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনের পরদিন দুদকের পক্ষ থেকেও একটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়, যেখানে পানাম পেপারসে আসা ৪৭ ব্যক্তি ৭ প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকাসহ মোট ৬৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তালিকা ছিল। এই ৬৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গত বছর ২৯ মার্চ ১৪ ব্যক্তির তালিকা আদালতে দাখিল করেছিল দুদক।
৬৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘৬১ ব্যক্তি ও ৭ প্রতিষ্ঠানের নামের যে তালিকা রয়েছে তা দিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে তালিকায় আসা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা, অফশোরে বিদেশে বিনিয়োগের সঠিক তথ্য ও সংশ্রিস্ট রেকর্ডপত্র পাওয়া না গেলে অনুসন্দানকাজে অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর না।
সংস্থাটির আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আদালত এই ৬৮টি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে দুদকের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছেন। পদক্ষেপ নিয়ে থাকলে তার অগ্রগতি জানাতে বলেছেন। ’
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ডিআরইউর মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়ার কথা বলেন। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে বাঙালি অধ্যুষিত কানাডার কথিত ‘বেগম পাড়ার’ প্রসঙ্গ।
সেসব প্রতিবেদন নজরে আসার পর ২০২০ সালে ২২ নভেম্বর হাই কোর্ট অর্থপাচারকারী দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানা চাওয়ার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, তা জানতে চায়।
এর মধ্যেই বিদেশি ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস। গত বছর ১ ফেব্রুয়ারি এ রিট আবেদনটি করা হয়।
সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পর ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেন। সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে, সে তথ্য জানতে চান হাইকোর্ট।
অর্থ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বাণিজ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, যৌথ মূলধন কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের রেজিস্ট্রার ও পুলিশ প্রধানকে হলফনামা করে প্রতিবেদন দিতে বলেন আদালত।
সেই সঙ্গে বিদেশী ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিক অথবা কম্পানি বা অন্য কোনো সত্ত্বার গোপনে গচ্ছিত টাকা উদ্ধারে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- জানতে চাওয়া হয় রুলে।
এ ছাড়া পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে বাংলাদেশী যেসব নাগরিক ও কোম্পানির নাম এসেছে, তাদের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং সে তদন্তের অগ্রগতি প্রতি মাসে আদালতকে জানাতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
বাংলাদেশী কোনো নাগরিক অথবা কম্পানি বা অন্য কোনো সত্ত্বার অর্থপাচার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের বিষয় নীরিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তার জবাবও চাওয়া হয় রুলে।
অর্থ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বাণিজ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিবকে চার সপ্তহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
সেদিন আদালত ৩০ মার্চ পরবর্তী আদেশের তারিখ রাখে হাই কোর্ট। এ আদেশের আট মাস পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়, যা গত বছর ২৪ অক্টোবর আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারল এ কে এম আমিন উদ্দিন সেদিন বাকিদের প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এক মাস সময় চাইলে আদলত গত ২১ নভেম্বর পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন গত বছর ৫ ডিসেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দেয়। বিএফআইইউ’র বরাত দিয়ে সেদিন দুদক পানামা পেপারসে উঠে আসা দেশের ৪৩ ব্যক্তি-সত্তা নামের তালিকা দেয়। পরদিন আদালত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে আসা অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি-সত্তার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে নির্দেশ দেন।
তারই ধারাবাহিকতায় বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক প্রতিবেদন দিলে আদালত তা দেখে পদক্ষেপ জানতে চাইলেন।