ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৫২ বার
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসাবে এগিয়ে যাচ্ছে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০। শতবর্ষের এ মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপ ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। এ সময়ে ৮০টি প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ হচ্ছে ৩৪ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি খসড়া ম্যাপিং চূড়ান্ত করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা। পাশাপাশি ডেল্টা উইং গঠনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। কাজ চলছে ডেল্টা ‘নলেজ ব্যাংক’ ও ‘ডিজিটাল তথ্য ভান্ডার’ স্থাপনের। আর সার্বিক কর্মকাণ্ডের আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ডেল্টা তহবিল গঠনের। সুষ্ঠুভাবে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন আরও জোরালো করতে খুব শিগগির সংশ্লিষ্ট ১০ মন্ত্রীকে নিয়ে বৈঠক করবেন ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আগামী ২০ থেকে ২৫ বছর দেশে অর্থনীতির উত্থান ঘটবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশ হবে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি আরও বলেন, ৫ বছর মেয়াদি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হবে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এগোচ্ছি। যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে-আশা করছি, এতে দেশে অর্থনীতি ও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আসবে।
ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনাকে-২১০০’ দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসাবে দেখছে সরকার। বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মতো দীর্ঘমেয়াদি ৬টি কৌশল রয়েছে প্ল্যান-২১০০ এ। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি)-এর অনুমোদন দেওয়া হয়।
ডেল্টা প্ল্যানের প্রথম ধাপের ৮০টি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণা সংক্রান্ত। এসব প্রকল্পে ব্যয় করা হবে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ব্যয় করা হবে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা, নদী ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হবে ৪৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহে ৬৭ হাজার ১৫২ কোটি টাকা, নদীভাঙন রোধে ৬৮ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য ৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা এবং খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য প্রকল্পে বরাদ্দ হচ্ছে ১৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। অন্যান্য প্রকল্পে বিনিয়োগ করার লক্ষ্য রয়েছে অবশিষ্ট ৮৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, মোটা অঙ্কের এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ ও সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, নেদারল্যান্ডস এডিবি ও জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
আরও জানা গেছে, এরই মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার কমিটি (টিএসি) গঠন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ডেল্টা প্ল্যান বিনিয়োগ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলো মূলত কর্মসূচিভিত্তিক। এসব কর্মসূচি পৃথকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে খসড়া ম্যাপিং। এর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। পাশাপাশি প্ল্যানের আলোকে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে। এ ছাড়া গঠন করা হয়েছে ২৫ সদস্যের একটি ফোকাল পয়েন্ট গ্রুপ। এ গ্রুপ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয় করবে।
বিআইডিএস’র সাবেক ডিজি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি বলেন, দূরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে ডেল্টা প্ল্যান। এ নির্দেশনার সঙ্গে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মিল রেখে কাজ করতে হবে। মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো এটি করছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তার সঙ্গে ডেল্টা প্ল্যানের অনেকটা মিল রয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়গুলো তাদের পঞ্চবার্ষিকী ও বার্ষিকী পরিকল্পা ডেল্টা প্ল্যানের সঙ্গে মিল রেখে করছে কিনা সেটি খেয়াল রাখতে হবে। ডেল্টা প্ল্যানে যে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে সেটি পৃথক কোনো বিনিয়োগ নয়, এটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখেই করা হয়েছে। তবে দূরবর্তী সিদ্ধান্ত হলেও এটি ছোট ছোট আকারে বিশেষ করে পাঁচ বছর মেয়াদে এর সুবিধা পাওয়া যাবে।
বিনিয়োগের ধরন: ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে ৮০টি প্রকল্প ব্যয়ের অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে প্রথম ধাপে আগামী ২০৩১ সালের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের সমান বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। এর আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ, বেসরকারি বিনিয়োগ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ স্থির করা হয়েছে। ২০৩১ সালেও উল্লিখিত হারে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
ডেল্টা উইং গঠন: ব-দ্বীপ বাস্তবায়নে ডেল্টা উইং গঠনের প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। এর অধীনে একটি অধিশাখা ও ৬টি শাখা সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে এটি পরিকল্পনা বিভাগে প্রক্রিয়াধীন আছে। এ উইং গঠন করার পর ডেল্টা প্ল্যানের সার্বিক সমন্বয়, বাস্তবায়ন, ত্বরান্তিত করা, পরিকল্পনা হালনাগাদ, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণের কাজ করবে।
ডিজিটাল তথ্য ভান্ডার স্থাপন: যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে একটি নলেজ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয় এটি। প্রথমটি হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লব্ধ ডেল্টা সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও তথ্য সংরক্ষণ করে ডিজিটাল নলেজ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠান করা, দ্বিতীয় ডেল্টা উপাত্ত ব্যাংক এবং ডেল্টা নলেজ হাব স্থাপন করা।
ডেল্টা তহবিল গঠন: এরই মধ্যে ডেল্টা তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দুটি ধাপে এটি করা হবে। প্রথম ধাপে ডেল্টা সংক্রান্ত সব ধরনের বিনিয়োগ ও পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণ নির্বাহের জন্য এটি বিবেচিত হবে। তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসাবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ এবং জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল, বিশেষ করে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব পিপিপি পদ্ধতিকে বিবেচনা করা হয়েছে।
জানা গেছে, কাউন্সিলে সদস্য হিসাবে রয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য এ কাউন্সিলের সদস্য সচিব হিসাবে কাজ করছেন।