ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ২১:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৪৭ বার
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার আগে কমপক্ষে তিনটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া খুব জরুরি। এগুলো হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরও বাড়ানো, দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বন্ধ করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে আরও দক্ষতা অর্জন করা।
এগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরও সক্ষমতা অর্জন বেশি প্রয়োজন। এসব দিক বিশ্লেষণ করে গড়ে যখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হবে, কেবল তখনই বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে-এর আগে নয়।
কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ ও শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নীতিমালায় দেশের রপ্তানিকারকদের শর্তসাপেক্ষে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অনুমোদন নিয়ে এই বিনিয়োগ করতে হবে। কমিটি ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে অনুমোদন দেবে। একই সঙ্গে কঠোর তদারকিও করবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য যে ধরনের সক্ষমতা থাকা দরকার, সেটা এখনো অর্জিত হয়নি। এর জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন। বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ভারসাম্য আরও শক্তিশালী অবস্থানে যেতে হবে।
তা না হলে দেশ থেকে বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ বাড়বে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করার চেয়ে দেশে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো জরুরি। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তদারকি কাঠামো এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। বিদেশে পুঁজি নেওয়ার নীতিমালা অনুযায়ী যে ধরনের তদারকি দরকার, সেই কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ দেখা যায়, বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় হচ্ছে বেশি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে এ হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। গত কয়েক বছর ধরেই এতে ঘাটতি হচ্ছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৪৫৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই নভেম্বরে এ ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২০ কোটি ডলারে। দেশে প্রতিবছর রেমিট্যান্স প্রবাহ গড়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এখন এ প্রবাহ কমছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। আমদানি ব্যয় হচ্ছে ৬ হাজার ৬৮ কোটি ডলার। রপ্তানি আয় হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় বাণিজ্যে ঘাটতি হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে ছিল ৩৫০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে নিট বৈদেশিক অনুদান এসেছে ৫৫৯ কোটি ডলার। করোনার কারণে আগের তুলনায় অনুদান বেড়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না। ঘাটতি মেটাতে হয় রেমিট্যান্স দিয়ে। আমদানি ব্যয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ রেমিট্যান্স দিয়ে মেটানো হয়। এ কারণে রেমিট্যান্স বা রপ্তানিতে সামান্য টান পড়লেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজার এলোমেলো হয়ে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হয়। রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার ছাড়তে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ৪ হাজার ৫১৪ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকলেই তাকে ঝুঁকিমুক্ত ধরা হয়। কিন্তু শুধু রিজার্ভ বেশি আছে-এ যুক্তিতে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমদানি ও রপ্তানি দুটোই বাড়ছে। তবে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বাড়ছে বেশি। ফলে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে। এ অবস্থায় রপ্তানি আয়ের রিটেনশন কোটা থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দিলে ওই কোটায় জমা বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে বিনিয়োগ হলে দেশে আসবে না। তখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমবে। অন্যদিকে অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। আমদানিও বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম হলে আমদানি ব্যয় মেটানো চ্যালেঞ্জিং হবে। এতে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, রপ্তানিকারকরা তাদের মোট রপ্তানি আয়ের ৪০ শতাংশ রিটেনশন কোটায় বিদেশে রাখতে পারেন।
ওই অর্থ তারা বিদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থে খরচ করতে পারেন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ সব সময় রাখতে পারেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ওই অর্থই বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার পরিবর্তে তা দেশেই বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া দরকার। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, দারিদ্র্য কমবে। তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগ আনার জন্য বিদেশে রোড শো হচ্ছে, অথচ দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এটা স্ববিরোধিতা।’ তিনি আরও বলেন, দেশ থেকে প্রতিবছর টাকা পাচার হচ্ছে। সেটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। আগে অবৈধভাবে টাকা পাচার হয়েছে। এখন বৈধভাবে যাবে। এ নীতিমালার রাজনৈতিক অপব্যবহারও হতে পারে।’
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি গ্রুপ বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা পুঁজি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। মুনাফা ও অন্যান্য ফি বাবদ দেশে ফেরত আনা হয়েছে ১ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। এর মধ্যে কেনিয়ায় ৫৮ লাখ ডলার, ভারতে ৪৪ লাখ ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৬ লাখ ২০ হাজার ডলার, ওমানে ২৪ লাখ ২০ হাজার ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন এটি শুধু তাদের তথ্য। এর বাইরেও বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। যেগুলোর তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নেই। তারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদনও নেননি। এর মধ্যে দেশের কয়েকটি ঋণ জালিয়াত প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বৈধভাবে বিদেশে কোনো পুঁজি নেওয়ার সুযোগ নেই। বৈধভাবে বিদেশে বিনিয়োগ করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত একটি কমিটি এ ব্যাপারে অনুমোদন দেয়। নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে এর আওতায় অনুমোদন দেওয়া হবে। নীতিমালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় চিঠি দিয়ে তাদের প্রতিনিধি চাওয়া হবে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হলে এর প্রথম বৈঠক হবে।
বর্তমানে যে কেউ বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে পারেন। নতুন নীতিমালার ফলে এখন শুধু রপ্তানিকারকরা বিনিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অন্য কেউ পারবেন না। তাও আবার সব রপ্তানিকারক আবেদন করতে পারবেন না। কেবল যেসব রপ্তানিকারকের আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে, তারা আবেদন করতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘কমিটি ঝুঁকি বিশ্লেষণ করেই অনুমোদনের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। ফলে অর্থনীতিতে ঝুঁকি আসবে না। ঝুঁকির সম্ভাবনা দেখলে অনুমোদন মিলবে না।’
কারা বিনিয়োগ করতে পারবেন : কেবল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের রিটেনশন কোটা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন। ওই কোটায় পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা থাকতে হবে। রপ্তানিকারকের আর্থিক সচ্ছলতাও থাকতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহী রপ্তানিকারকদের ক্রেডিট রেটিং গ্রেড দুই হতে হবে। বিনিয়োগ প্রস্তাবটি নির্ভরযোগ্য ও লাভজনক হতে হবে। থাকতে হবে বৈদেশিক আয়ের সম্ভাবনা। নিয়মিত রপ্তানি আয় দেশে এসেছে এবং আমদানি দায় পরিশোধিত হয়েছে বলে ব্যাংক থেকে সনদ নিতে হবে। শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর নিয়মিত পরিশোধিত থাকতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘রপ্তানিকারকরা রিটেনশন কোটায় যে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখেন, সেগুলো বিদেশে ব্যবসার উন্নয়নে ব্যয় হয়ে যায়। ওই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা থাকে না। বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হলে রিটেনশন কোটার হার আরও বাড়াতে হবে। নীতিমালায় আরও শিথিলতা আনতে হবে।’
কারা বিনিয়োগ করতে পারবেন না : কোনো ঋণখেলাপি বা পুনর্গঠিত বড় অঙ্কের ঋণ আছে-এমন কোনো রপ্তানিকারক বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারবেন না। এছাড়াও কোম্পানির আর্থিক অসচ্ছলতা থাকলেও বিনিয়োগ করা যাবে না।
বিনিয়োগ করা যাবে যেসব দেশে : সব দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করা যাবে না। যেসব দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাজ করার ও তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণের কোনো বাধা নেই, বাংলাদেশের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় পুঁজি বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ চুক্তি রয়েছে, ওইসব দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করা যাবে।
যেসব দেশে বিনিয়োগ করা যাবে না: যেসব দেশে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন ট্রাস্কফোর্স কর্তৃক যেসব দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই-ওইসব দেশে বিনিয়োগ করা যাবে না।