ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৩২ বার
দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এতে সার্বিক অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি, আমদানিতে ঘাটতি অর্থায়নে প্রধান ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স।
পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষা ও টাকার প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে এর অগ্রণী ভূমিকা। এছাড়া শুধু রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে অর্থনীতির অনেক সূচক সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার রেমিট্যান্স হঠাৎ করে কমতে থাকলে অর্থনীতির নানা সূচকে চাপ বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-অতীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য শ্রীলংকা রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করে এখন সংকটে পড়েছে। চীন ও কানাডা রপ্তানির ওপর নির্ভর করে ২০০৭ সালের বৈশ্বিক মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশকে এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য এককভাবে রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর না করে বহুমুখী উৎস বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো কিছুতেই বেশিদিন একক নির্ভরশীলতা ভালো নয়।
তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্সের অর্থ ভোগবিলাসে ব্যয় না করে উৎপাদন খাতে ব্যয় করতে হবে। সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে। তাহলে শিল্প হবে, উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার খুলবে। ফলে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। আমদানি বাড়ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোরও কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু রেমিট্যান্সের পাশাপাশি অন্যান্য উৎস যেমন-রপ্তানি, বিদেশি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেবা প্রদান, পরামর্শক বাবদ ফি আয় বাড়ানো উচিত। তা না হলে হঠাৎ করে রেমিট্যান্স কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ বেড়ে যায়। যেটা বাংলাদেশে ২০০১ সালে হয়েছে। বর্তমানেও হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্সে আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ছিল আড়াই শতাংশ নেতিবাচক। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, রেমিট্যান্স বাড়ায় দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে টাকার প্রবাহ বেড়েছে, দরিদ্রতা কমেছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, বাজারে ভোগের চাহিদা তৈরি হয়েছে, এতে বেড়েছে উৎপাদন। সব মিলে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এর অবদান বেড়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রাখতেও ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। আমদানির ঘাটতির অর্থায়নে রেমিট্যান্সের অবদান বেড়েছে।
এদিকে রেমিট্যান্স ছাড়া সরকারিভাবে এগুলো করা খুব কঠিন। দেশের বিভিন্ন সংকটে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রেমিট্যান্সের অবদান ছিল ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর আগে আরও বেশি ছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা কমে ৫ দশমিক ১১ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা আরও কমে নেমে আসে ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরও বেড়ে ৪ দশমকি ৮৭ শতাংশে ওঠে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ অবদান রেখেছে।
দেশের রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি থাকে। রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি বাড়ায় এ ঘাটতি আরও বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৩ হাজার ৯৭২ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৬৮ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে আমদানি বেড়েছে ২ হাজার ৯৬ কোটি ডলার বা ৫৩ শতাংশ।
একই সময়ে রপ্তানি আয় ৩ হাজার ৩৪৪ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলার হয়েছে। আলোচ্য সময়ে আয় বেড়েছে ৫৩২ কোটি ডলার বা ১৬ শতাংশ। ওই সময়ে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেড়েছে প্রায় চারগুণ বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছিল ৬২৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১৯২ কোটি ডলার।
আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় কম বাড়ায় আমদানিতে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হচ্ছে রেমিট্যান্স থেকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট আমদানির ৩৭ দশমিক ৪২ শতাংশ ঘাটতি রেমিট্যান্স থেকে মেটানো হয়েছিল। গত অর্থবছরে ৪০ দশমিক ৮৩ শতাংশ আমদানির ঘাটতি মেটানো হয়েছে রেমিট্যান্স থেকে।
রেমিট্যান্স থেকে আমদানি ব্যয়ের ৪০ দশমিক ৮৩ শতাংশ মেটানোর পর বাকি ৫৯ শতাংশ দেশের রিজার্ভে যোগ হচ্ছে। এতে হু-হু করে বেড়েছে রিজার্ভ। ২০১৬ সালের জুনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার কোটি ডলার। এখন তা বেড়ে ৪ হাজার ৫৪৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশাল আমদানি ব্যয় মেটানোর পরও রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে রিজার্ভ বেড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ডলার উদ্বৃত্ত থাকে। কম হলে ঘাটতি দেখা দেয়। এ হিসাবে ঘাটতি হলে টাকার মান ধরে রাখার ওপর চাপ পড়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৭১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে উদ্বৃত্ত কমে ঘাটতি হয়েছে ৪৫৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এ ঘাটতি আরও বেড়ে ৮১৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
মূলত রেমিট্যান্স কম আসায় এ হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে। ফলে টাকার মানে চাপ পড়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাবে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে গড়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে আড়াই থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ। এতে ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০০১ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। তখন এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের বা আকুর (বাংলাদেশসহ নয়টি দেশ বাকিতে পণ্য আমদানি রপ্তানি করে দুই মাস পর পর দায়দেনা সমন্বয় করে) দেনা পরিশোধ করতে পারেনি। সোয়াপ পদ্ধতিতে (আকু থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দেনা সমন্বয় করেছিল।