ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ মার্চ, ২০২২ ০৯:০০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৯১ বার
জালিয়াতিতে জড়িয়েছেন অসাধু ব্যাংকাররা * ১২ কেলেঙ্কারিতে খেলাপি বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা
ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের একটি অসাধু অংশের পাশাপাশি ব্যাংকাররাও দুর্নীতির চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন।
ব্যাংকের কিছু পরিচালকের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এর প্রসার ঘটেছে। ফলে জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এক পর্যায়ে এসব ঋণের গ্রাহকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। পরিণত হচ্ছে বেনামি ঋণে। যাদের অস্তিত্ব মিলছে তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় হচ্ছে না।
ফলে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ। কমে যাচ্ছে আয়। ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। সব মিলে দুর্নীতির চক্রে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংক খাত। এর মধ্যে দুই বছর ধরে চলছে করোনার আঘাত। এতে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা আরও প্রকট হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ব্যাংকিং খাতে মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে। গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, আমানত কমেছে, টাকা তোলার হার বেড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে, প্রণোদনার ঋণ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, ছোটদের কাছে প্রণোদনার ঋণ পৌঁছানো যায়নি যথাসময়ে। তারল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায়ও শৃঙ্খলা ফেরেনি। ঋণ আদায় এখনো তলানিতে। বাড়েনি বিনিয়োগ সক্ষমতা।
তবে আশার কথা, গত দুই বছরে করোনার প্রভাব মোকাবিলা করতে যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছিল সেগুলো ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে ব্যাংক খাত। নতুন করে করোনার আর কোনো আঘাত না এলে ২০২৩ সালের মধ্যে করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, করোনার আগের চেয়ে গত দুই বছরে ব্যাংক খাতে সুশাসন ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে। গত দুই বছরে ঋণ আদায়ে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা পুরো স্বাভাবিক করা কঠিন।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে ঋণ আদায় স্থগিত থাকায় ও খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হার বেড়েছে। দুই বছর আগে এ সম্পদ ৯ শতাংশের নিচে ছিল। এখন তা বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কমেছে।
ব্যাংকগুলোর ঋণ থেকে আয় কমেছে। বেড়েছে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন থেকে। সরকারি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণ থেকে সুদ আয় এখনো নেতিবাচক। তবে গত বছরের তুলনায় এ হার কিছুটা বেড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এ আয়ও কমেছে। তবে গত ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছে।
ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান অংশই আসার কথা সুদ থেকে। কিন্তু এ খাতের আয় কমে গেছে। অন্য খাতে বিশেষ করে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন থেকে আয় বেড়েছে। এ ধরনের আয় ব্যাংক খাতকে টেকসই করতে পারে না, বরং ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু করোনার সময়ে সুদ আদায় স্থগিত থাকায় এ খাতে আয় কমেছে। যে আয় হয়েছে তাতেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। কেননা করোনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ছাড় দিয়েছে।
কোনো ঋণ বা সুদ পুরো আদায় না হলেও ২৫ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করলে ওই সুদ আয় খাতে নিতে পারবে। এছাড়া নিয়মিত ঋণের সুদও আয় খাতে নিতে কোনো বাধা নেই। ফলে ব্যাংকগুলোর সুদ আদায় করেই তা কাগজে-কলমে আয় খাতে নিয়ে মুনাফা দেখিয়েছে। তাতেও এ খাতে আয় আগের চেয়ে কম। এটি ব্যাংক খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি বলে মনে করছেন বিশ্লেকরা। তাদের মতে, কাগুজে আয় দিয়ে ব্যাংক টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কাগুজে মুনাফা সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি বিপদ ডেকে আনবে। কাগুজে মুনাফার প্রবণতা থেকে বের হওয়াটা জরুরি। ব্যাংক খাতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুশাসনের। এর অভাব বেশি থাকলে আর্থিক খাতের মেরুদণ্ড আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন সোজা করে দাঁড় করানো কঠিন হবে।
সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি থেকে সফটওয়্যারভিত্তিতে ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। আরও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এছাড়া ঋণ বিতরণে অনিয়মের চিত্রও উঠে আসছে।
মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে বেনামি হিসাব থাকার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও ব্যাংকে বেনামি হিসাবের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। এসব হিসাবে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হচ্ছে। যেগুলো আদায় হচ্ছে না। খেলাপি হয়ে ব্যাংকের ভিতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের একটি অংশ জড়িত। প্রণোদনার ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোতে যে জালিয়াতি হয়েছে তার সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বড় বড় যেসব ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সঙ্গেও ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়। সেখানেও বেনামে হিসাব খোলা হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গেও কতিপয় অসাধু ব্যাংকারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বড় ধরনের ১২টি ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মাধ্যমে নেওয়া ঋণের মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে গত এক বছরে অনারোপিত সুদ এসেছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। যা ব্যাংক আদায়ও করতে পারছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যায়নে কেবল দুর্নীতির কারণে ১২টি ব্যাংকের অবস্থা বেশ খারাপ। এগুলোকে নীতি সহায়তায় ছাড় দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে বড় বড় জালিয়াতি হলেও সরকারি গ্যারান্টির কারণে সচল আছে। একটি ব্যাংকে ১২ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও কিছু ঋণ নিয়মিত হয়েছে। বাকিগুলো খেলাপি। করোনায় ঋণ শিথিলতার সুযোগ নিয়ে অনেক ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে। এর মধ্যে জালজালিয়াতির ঋণও রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের থাবা এখনো বেশ জোরালো। পরিচালকরা নিজ ব্যাংকের পাশাপাশি অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এ ঋণ প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে রয়েছে বেনামি ঋণ।
করোনার সময়ে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিধিবিধান অনেক শিথিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নামমাত্র সুদে তহবিলের জোগান দেওয়া হলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পুরোনো গ্রাহকদের পাশাপাশি অনেক নতুন গ্রাহকের মধ্যে ঋণ বিতরণ করা। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কম হওয়ার কারণে।
ব্যাংকগুলো তাদের মোট আমানতের ৮৮ থেকে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ও মূলধনের অংশের পুরোটাই বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকারি মোট আমানতের ৫২ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৭৫ শতাংশ ও বিদেশি ব্যাংকগুলো ৫৪ শতাংশ বিনিয়োগে সক্ষম হয়েছে। বাকি অর্থ অলস পড়ে রয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। প্রণোদনার ঋণ দিতে দুই দফায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আধা থেকে ৩ শতাংশ সুদে জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এ তহবিলের বড় অংশ ব্যবহার হয়নি। ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকেও ঋণ ছাড় করতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বড় দুর্বলতা হিসাবে দেখছে। বড় দুর্যোগের সময়ই ব্যাংকের সেবার হাত সম্প্রসারিত করার মতো কাঠামো এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এ দুর্বলতা রোধে ছোট, বড় বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের একটি তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে দুর্যোগের সময়ে ঋণ সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুনের পর থেকে হঠাৎ করে ব্যাংকের আমানত কমতে শুরু করেছে। এজন্য তারা দুটি কারণ শনাক্ত করেছে- ১. হঠাৎ করেই রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা এবং ২. করোনার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় পারিবারিক ব্যয় বেড়ে যাওয়া। তবে আমানত কমলেও ব্যাপক পরিসরে ব্যাংক খাতে এখনো স্থিতিশীলতা রয়েছে। এখনো যে অতিরিক্ত তারল্য আছে তা দিয়ে ঋণের বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থের জোগান দেওয়ার পথ খোলা রাখা হয়েছে। তবে এতে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে আমানত বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। গত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমানত কমেছে ৫২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল ৪৪ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে তারল্য কমে যাওয়ার তিনটি কারণ শনাক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১. ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, ২. আমানত প্রবাহ হ্রাস এবং ৩. ডলারের জোগান বাড়ানো।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ৪৪ শতাংশ কমেছিল। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে ৯৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বেরিয়েছে। এছাড়া আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় ব্যাংকগুলোকে ওই সময়ে ৩২৮ কোটি ডলারের জোগান দিয়েছে। এর বিপরীতে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে।
ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় আরও একটি দুর্বলতা শনাক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেটি হলো বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ। ব্যাংকগুলো বাজারে বিনিয়োগ করতে না পেরে চাহিদার তুলনায় বেশি অর্থ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করে। গত ফেব্রুয়ারিতে চাহিদার তুলনায় প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি জমা আছে। করোনার কারণে ব্যাংকিং খাতে ঋণের চাহিদা কমেছে। আগে বছরে গড়ে ১৮ শতাংশ ঋণ বাড়ত। দুই বছর ধরে চাহিদা ৮ শতাংশের বেশি বাড়ছে না।