ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২০ মার্চ, ২০২২ ১১:১১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৬১৯ বার
ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা শাহনাজ চৌধুরী ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য সাড়ে নয় শতাংশ সুদে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর পরেই ব্যাংক তার সেই সুদ হার সাড়ে ১২ শতাংশ করে ফেলে।
‘আমি যখন ব্যাংকের শাখায় গিয়ে অভিযোগ করি, তখন তারা আমাকে কাগজপত্রের ভেতর শর্ত দেখান যে, ব্যাংক বিভিন্ন সময় সুদের হার পরিবর্তন করতে পারবে। ফলে আমাকে সেটা মেনে নিতে হয়েছে।’ বলছিলেন শাহনাজ চৌধুরী।
ব্যক্তিগত পারিবারিক বা ব্যবসার প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে অনেকেই ঋণ নিতে চান। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দেয়ার প্রক্রিয়াও অনেক সহজ করেছে। কিন্তু ঋণ নেয়ার আগে যেমন অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়, তেমনি অজ্ঞতার কারণেই হয়তো ঋণ নেয়ার পরেও কেউ কেউ পড়ে যান শাহনাজ চৌধুরীর মত বিপদে।
ব্যাংক ঋণ নেয়ার জন্য কোন কোন বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন? তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে:
ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংক কি কি বিষয় বিবেচনা করে?
সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘যেকোনো ব্যাংক ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা করে যে, সে ঋণের টাকা ঠিকমতো ফেরত পাবে কিনা। কোনো গ্রাহক যদি এটা প্রমাণ করতে পারেন, যে উদ্দেশ্যে তিনি ঋণ চাইছেন, সেটা সঠিক, তিনি যথাসময়ে ঋণের টাকা সুদসহ ফেরত দিতে পারবেন, তখনই তাকে ব্যাংক ঋণ দিতে সম্মতি দেয়।’
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ শর্ত রয়েছে।
যেমন ঋণ গ্রহীতার বয়স ১৮ বছরের ওপরে হতে হবে, তার নিয়মিত আয় থাকতে হবে। ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তাকে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে।
ঋণ আবেদনকারী কত টাকা ঋণ পাবেন, তা নির্ভর করে তার আয়-উদ্বৃত্ত কতটা, অথবা ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কতটা, তার ওপরে।
আয়-উদ্বৃত্ত হল একজন ব্যক্তি যত টাকা আয় করে, সেখান থেকে ইনকাম ট্যাক্স বা অন্য ঋণের কিস্তি পরিশোধের পর কত টাকা থাকে। ব্যাংক ভেদে যদিও এর রকমফের হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংক এই আয়ের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সক্ষমতা বলে ধরে নেয়।
সেই সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যাংক তাকে ঋণ বরাদ্দ করে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আয়কর পরিশোধের পর একজন ব্যক্তির মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকা।
ব্যাংক হিসাব করবে, তার ২৫ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য সক্ষমতা রয়েছে। সেখান থেকে হয়তো একটি ঋণের কিস্তি হিসাবে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়।
এখন ব্যাংক তাকে সেই পরিমাণ ঋণ বরাদ্দ দেবে, যাতে ঋণ পরিশোধে সুদ ও আসলসহ তার মাসিক কিস্তির পরিমাণ ২০ হাজার টাকার মধ্যে থাকবে।
এর পাশাপাশি ওই ব্যক্তির অতীত ঋণ পরিশোধের তথ্য, অন্য ব্যাংকে আর কোনো ঋণ আছে কিনা, অন্যান্য সম্পদ কেমন রয়েছে, চাকরির বা ব্যবসার ধরন-ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখে।
যেমন সরকারি চাকরিজীবী, চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর মতো পেশাজীবীদের ব্যাংক বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আবার এমন কিছু পেশা রয়েছে, যেক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে।
বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শামস উল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমরা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে দেখি তার ব্যবসায় ক্যাশ ফ্লো কতটা আছে, টার্ন ওভার কেমন, সিআইবি রেকর্ড কেমন, অতীতে খেলাপি বা ক্লিন ইমেজ আছে কিনা, কী ধরণের ব্যবসা করছেন ইত্যাদি। সেই সঙ্গে তার ব্যবসা দেশের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখছে, সেটাও আমাদের বিবেচনায় থাকে।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটে যেমন বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত ঋণ নিতে হলে গ্রাহককে দেড় বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা অথবা দুই বছরের ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন হতে হবে ১৮ হাজার টাকা, বেসরকারি চাকরিজীবীদের ৩০ হাজার টাকা। ব্যবসায়ী হলে আয় হতে হবে ৫০ হাজার টাকা।
তবে এই ব্যাংক থেকে বাড়ি কেনার ঋণ নিতে হলে সরকারি কর্মচারীর সর্বনিম্ন বেতন হতে হবে ২৫ হাজার, বেসরকারি চাকরিজীবীর ৪০ হাজার আর ব্যবসায়ীর আয় হতে হবে ৫০ হাজার টাকা।
কী ধরণের ঋণ দিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো নানা নামে বিভিন্ন ধরনের ঋণ দিয়ে থাকে। যেমন ব্যক্তিগত ঋণ, ভ্রমণ ঋণ, পড়াশোনার ঋণ, চিকিৎসক ঋণ, বিবাহ ঋণ, গাড়ি কেনার ঋণ, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ঋণ ইত্যাদি। এর বাইরে ব্যবসার জন্য নানা ধরনের ঋণ, এসএমই ঋণ, কৃষি ঋণ, শিল্প কারখানার জন্য ঋণ- ইত্যাদি রয়েছে।
ব্যাংক মোটা দাগে এসব ঋণকে চারটি ভাগে ভাগ করে। যেমন সিকিউরড ঋণ, নন সিকিউরড ঋণ, এসএমই বা কৃষি ঋণ আর কর্পোরেট ঋণ।
ব্যক্তিগত ঋণগুলো নন-সিকিউরড ঋণ হয়, যেজন্য কোনো জামানত দিতে হয় না। তবে অনেক ব্যাংক গ্যারান্টার নিয়ে থাকে। গাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি মর্টগেজ বা সিকিউরড ঋণ হিসাবে গণ্য হয়।
এর বাইরে এসএমই সিকিউরড বা নন-সিকিউরড দুইটাই হতে পারে। কৃষি বা শিল্প ঋণ সাধারণ মর্টগেজ ঋণ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মতো কিছু বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে, যারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি খাতের পেশাজীবীদের ঋণ দিয়ে থাকে।
যেমন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক যে উদ্দেশ্যে বা চার্টারে তৈরি হয়েছে, শুধুমাত্র সেই উদ্দেশ্যে বা শ্রেণির মানুষদের ঋণ দিয়ে থাকে।
সুদের হার কীভাবে নির্ধারিত হয়?
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার আমানত ও ঋণের সুদের হার ৬-৯ পার্সেন্ট বেধে দিয়েছে।
ফলে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশের ওপর সুদ নিতে পারে না। বরং ঋণ গ্রহীতার অতীত ঋণের ইতিহাস, পেশা বা আয়ের ওপর নির্ভর করে অনেক সময় আরো কম সুদ হার দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শামস উল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমরা চেষ্টা করি সবসময়েই সবচেয়ে কম সুদ দেয়ার। এখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদ নেয়া হয়। তবে কাস্টমারের রেকর্ড ভালো হলে সেই সুদের হার আরো কমিয়েও দেয়া হয়।’
প্রতিবেদনের শুরুতেই যে শাহনাজ চৌধুরীর কথা বলা হয়েছে, যিনি একরকম সুদহারে ঋণ নেয়ার কিছুদিন পর দেখেছিলেন তার সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এমনটি কেন ঘটে?
একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘পার্সোনাল ঋণগুলো সাধারণত ফিক্সড রেটে হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুদের হার বাড়ুক বা কমুক না কেন, সেই সুদের হারে পরিবর্তন হয় না। তবে গাড়ি বা বাড়ি কেনার সুদের হার সাধারণত পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে। সুদের হার বাড়লে সেটা বাড়বে, সুদের হার কমলে সেটা কমবে।’
ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরের যে চিঠি দিয়ে থাকে, সেখানে ঋণের হার পরিবর্তনশীল কিনা, সেটি উল্লেখ থাকে বলে এই কর্মকর্তা জানান। ঋণ গ্রহণের চূড়ান্ত সম্মতির আগে ব্যাংকের মঞ্জুরি পত্র ভালোভাবে পড়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
মোঃ শামস উল ইসলাম বলছেন, ‘কখনো যদি ডিপোজিটের সুদ হার বাড়ে, তখন আমাদের ঋণের সুদের হারও বাড়াতে হবে। কারণ ব্যাংক তো গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে সেটাকেই আবার ঋণ দিয়ে ব্যবসা করে থাকে। সবসময়েই সেটা ব্যাংকের ঋণের শর্তে উল্লেখ থাকে। তবে রাতারাতি সেটা বেড়ে যে অনেক হয়ে যায়, এমন নয়। বাড়লেও আস্তে আস্তে বাড়ে।’
ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, আগে বরাদ্দ ঋণের সুদহার বছরে ০.৫ শতাংশের বেশি পরিবর্তন করা যায় না।
তবে কর্পোরেশন, শিল্প বা বড় আকারের ঋণের ক্ষেত্রে আলোচনার ভিত্তিতে সুদহার নির্ধারণ করা হয়। সেটাও বিভিন্ন সময় আমানতের সুদের হারের সঙ্গে মিল রেখে পরিবর্তিত হতে পারে।
ঋণ পেতে হলে কী কী লাগে?
একটি ব্যাংক থেকে আরেকটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের পার্থক্য দেখা যায়। তবে যে ব্যাংকে ঋণ আবেদন করা হয়, সেখানে গ্রাহকের হিসাব থাকতে হবে।
এছাড়া আয় প্রমাণের জন্য কমপক্ষে ছয় মাসের পে-স্লিপ অথবা ব্যবসার রিটার্ন, স্যালারি সার্টিফিকেট, টিআইএন, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ট্রেড লাইসেন্স, চাকরির প্রমাণপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, বাসার ঠিকানার বিলের কপি ইত্যাদি দিতে হয়। অনেক ব্যাংক গ্যারান্টার চেয়ে থাকে। কমপক্ষে দুইজন স্বজনকে রেফারেন্স হিসাবে দিতে হয়।
গাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে হলে সেসব সম্পত্তির বিস্তারিত কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সেই সঙ্গে এসব সম্পত্তি ব্যাংক ও গ্রাহকের যৌথ নামে কিনতে হবে। ঋণ শোধ হলে গ্রাহক পুরোপুরি মালিকানা পাবেন।
কৃষি, ব্যবসা ঋণ, শিল্প-কারখানার ঋণের ক্ষেত্রে অনেক সময় জমি, ভবন, কারখানা ইত্যাদি জামানত হিসাবে ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে সম্পত্তির সকল কাগজপত্র ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হবে।
চলমান অন্যান্য ঋণ থাকলে সেসব ঋণ অনুমোদনের চিঠি এবং গত এক বছরের লেনদেন বিবরণী দরকার হবে।
বড় আবাসিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি মিলে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সবার জন্য এসব কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
ক্রেডিট রেটিং তথ্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার রয়েছে, যাকে বলা হয় ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি।
বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংক থেকে যদি কেউ ঋণ নিয়ে থাকেন, এই সিআইবিতে তার তথ্য থাকে।
ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটা ব্যাংক এই সিআইবি থেকে তথ্য যাচাই করে থাকে।
গ্রাহক ঋণ আবেদনে কোনো ভুল তথ্য দিয়েছেন কিনা, অন্য কোনো ব্যাংকে তার ঋণ আছে কিনা, ইত্যাদি তথ্য যাচাই করে দেখতে পারে।
কেউ যদি অতীতে ঋণ বা ক্রেডিট কার্ডের কিস্তি পরিশোধে অনিয়ম করে থাকেন, সেক্ষেত্রে তাকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ঝুঁকি বেশি বলে বিবেচনা করে থাকে।
সূত্র : বিবিসি