ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৬ মার্চ, ২০২২ ১২:৩৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৭১৫ বার
দেশের ৪৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ১৫ হাজার ১৯৪ জন। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৫১১ জন ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন। এটা মোট শিক্ষকের ২৩ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে এসব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চাকরির প্রবণতাও বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বড় কয়েকটি বাদে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট আছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকের সংকট বেশি। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পাচ্ছে না। এ
মন পরিস্থিতিতে জুনিয়র শিক্ষক দিয়েই চলছে সেখানকার লেখাপড়া। এরমধ্যেই শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের ছুটিতে যাওয়ায় লেখাপড়া ও গবেষণার ওপর প্রভাব পড়ছে।
শিক্ষকদের ছুটির বিষয়ে সম্প্রতি ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, জ্ঞান সৃষ্টি ও নতুন জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষা কিংবা দেশ-বিদেশে সেমিনার, সম্মেলন বা গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করার জন্য যাওয়া অপরিহার্য। এজন্য তারা ছুটিতে যেতেই পারেন। এটা স্বাভাবিক বিষয়। এতে শিক্ষকের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে।
বিপরীত দিকে পিএইচডির মতো দীর্ঘ ছুটিতে কেউ গেলে তার বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগের বিধানও আছে। সুতরাং এ ধরনের ছুটি একাডেমিক কার্যক্রমে তেমন প্রভাব ফেলার কথা নয়, যদি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিজনিত শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হয় কোনো বিভাগে একই বছরে একাধিক শিক্ষককে ছুটি দিলে। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এটা ঠিক যে, মাঝেমধ্যে খবর পাওয়া যায়- উচ্চতর শিক্ষা শেষে অনেকে দেশে ফিরছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা যোগাযোগও করেন না। এ ধরনের তৎপরতা অন্যায় ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবছর ইউজিসি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৭তম প্রতিবেদনে ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৫১১ শিক্ষক অন্তত ৫ ধরনের ছুটিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে ২০৮৮ জন আছেন শিক্ষাছুটিতে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ২২৬৪ জন আর ২০১৮ সালে ২১৩৩।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত বছরে প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ৭৬ জন। এছাড়া বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন ২০৩ জন আর ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন ৪৩ জন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩ জন। তবে ২০১৮ ও ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭০ জন ও ২৫ জন। খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ১২০১ জন।
খণ্ডকালীন চাকরিতে সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির ১৫১৮ শিক্ষকের মধ্যে ২০২০ সালে ৫৪২ জন খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন। শিক্ষা ছুটিতে ৩১২, প্রেষণে ১৭, বিনা বেতনে ২৮ আর অননুমোদিত ছুটিতে ছিলেন ৪ জন।
খণ্ডকালীন ছুটিতে এরপরের অবস্থান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওই প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক বা ৭৭৮ জনের মধ্যে ৩৯৫ জনই ছুটিতে ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি বা পরামর্শকসহ বিভিন্ন পদে বেশি কদর বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। যে কারণে তাদের অনেকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়-ছুটি মনোভাবও বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করা শিক্ষকের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হালনাগাদ তথ্য রাখে না। এছাড়া ইউজিসির মতো কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানেও এ ধরনের তথ্য নেই।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি থাকায় পার পাওয়ার প্রত্যাশা থেকেও অনেকে অননুমোদিত ছুটি ভোগ করে থাকেন। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে অননুমোদিত ছুটির কারণে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিচ্যুতিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও আছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দর্শন বিভাগের ‘স’ আদ্যাক্ষরের এক সহকারী অধ্যাপক ছুটি ছাড়াই ১১ মাস অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। এরপর ফিরে এলে জবি কর্তৃপক্ষ তার যোগদান অনুমোদন করেনি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ তার কাজে পুনঃযোগদানপত্র নিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হাসান বলেন, ওই শিক্ষক ছুটির দরখাস্ত দিয়েছিলেন।
কিন্তু তা অনুমোদনের আগেই তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দর্শন বিভাগেও একই ধরনের ঘটনা আছে। ওই বিভাগের ‘ফ’ আদ্যাক্ষরের এক অধ্যাপক বিদেশে লিয়েনে চাকরি নিয়ে যান। যাওয়ার আগে তিনি দরখাস্ত করেন কিন্তু তা অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করেননি। এ প্রসঙ্গে ওই অধ্যাপক শুক্রবার বলেন, শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি তৎকালীন প্রশাসনের এক প্রভাবশালীর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। এ কারণে যথাসময়ে ছুটির দরখাস্ত দেওয়ার পরও তা অনুমোদন করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে একটি সেমিনারে যাওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের একটি ঘটনা আছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, জাবির উল্লিখিত শিক্ষক অধ্যাপক পদের জন্য বিদেশে অবস্থানকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তিনি আবেদনটি দাখিল করেননি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে আবেদনকারী এই অধ্যাপক দাবি করেন, এক সহকর্মীর মাধ্যমে তিনি স্বাক্ষর করে আবেদনটি অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠিয়েছেন, যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আবেদন জমা হয়েছে। আর জাবি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানো আবেদন কবে জমা পড়েছে তা তার জানা নেই। আবেদন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করছেন আরও ৫ শতাধিক। আর ইউজিসির উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করছেন ৩৫৬৫ জন। তাদের মধ্যে ১০৩২ জনই অধ্যাপক।
এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক ৫০৯ জন, ৬৪৬ জন সহকারী অধ্যাপক এবং ১২৬৪ জন প্রভাষক। অন্য ধরনের খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন ১১৪ জন। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত এসব শিক্ষকের বড় একটি অংশ কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক। কোনো রকমে ক্লাস নিয়ে কিংবা ফাঁকি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ তাদের অনেকের বিরুদ্ধে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কম-বেশি বঞ্চিত হচ্ছে।