ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৬ মার্চ, ২০২২ ১৩:১৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৯৪ বার
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বেঁধে দেওয়া মূল্যে ব্যবসায়ীরা খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রি করছেন না। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার থেকে যেসব নীতি-সহায়তায় ছাড় দেওয়া হয় সেগুলোও খুব কম সময় নিয়ে। ফলে এর সুফল বাজারে পড়ে না।
সরকারি সংস্থাগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে মূল্য প্রকাশ করে তার সঙ্গেও বাজারে মিল নেই। চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যেও রয়েছে গরমিল। প্রতিটি বাজারে পণ্য মূল্যের তালিকা প্রতিদিন হালনাগাদ করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। কেনাবেচায় লিখিত রসিদ থাকার কথা থাকলেও তার হদিস মিলছে না।
চাহিদা অনুযায়ী আমদানি পণ্যের এলসি খোলা বা দেশে আনার বিষয়টিতেও নেই যথাযথভাবে তদারকি। বাজার মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে নেই সমন্বয়। এসব মিলে বাজার ব্যবস্থাপনায় চলছে বিশৃঙ্খলা। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ভোক্তাদের। পণ্য কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।
সূত্র জানায়, বুধবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ৪০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে। ওই মূল্য অনুযায়ী খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রি করতে হবে। কিন্তু বাজার ঘুরে ওই দামে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি পণ্যই ৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিবছরই রোজার আগে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে বৈঠক হয়। ওইসব বৈঠকে উপস্থিত থাকেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিএফটিআই, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড টেরিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী গ্রুপসহ সরকারের একাধিক আইনশৃঙ্খলা এজেন্সি।
এ বছরও বৈঠক হয়েছে এ মাসের শুরুর দিকে। কিন্তু বৈঠক হয় তবে এর সুফল আর রোজায় মেলে না। কারণ এ সময়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তার সুফল চলে যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে। গত বছর রমজানের আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে সরকারের নজর রয়েছে। যখন যা প্রয়োজন তাই করা হবে। অসাধু পন্থা নিলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। ২০২০ সালেও একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাজারে এর প্রতিফলন ঘটেনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আগে থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকার কি করছে সেটি ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে। অনিয়ম করলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই ভোক্তা সরকারের উদ্যোগের সুফল পাবে।
ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু দেশে সেটি হচ্ছে না। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর করার কিছু থাকে না। তিনি আরও বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পাবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর প্রথম থেকেই মিলাররা কারসাজি করে সব ধরনের চালের দাম বাড়াতে থাকে। মিলারদের কারসাজি রোধে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ২০২০ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের বৈঠকে সবচেয়ে ভালো মানের ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম মিলগেটে ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের মধ্যে বিআর-২৮ চালের দাম ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু তখন এই বেঁধে দেওয়া দাম মিল পর্যায়ে মানা হয়নি। সে সময় মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা বিআর-২৮ জাতের চালের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ২০০ টাকা। তখন বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
একই সময়ে পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও অসাধুদের কারসাজিতে হঠাৎ করেই অস্থির হয় আলুর বাজার। এ সময় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু সর্বোচ্চ ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রথম দফায় ৭ সেপ্টেম্বর হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার। তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পরে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে ২০ অক্টোবর দাম পুনর্নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
সেক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ৩৫ টাকা, কোল্ডস্টোরেজ বা হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৭ টাকা এবং পাইকারিতে ৩০ টাকা করা হয়। কিন্তু তখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৩৫-৪০ টাকা। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হিমাগার পর্যায়ে আলু বিক্রি হয়েছে ৩৩-৩৬ টাকা।
তখন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, দেশে আলুর পর্যাপ্ত মজুত আছে। কেজিতে খুচরা পর্যায়ে ৩৫ টাকার বেশি ওঠার কোনো কারণ নেই। অনেকেই প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে আলু বিক্রি করলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাধ্য হয়েই আলুর যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এটিকে কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালে সরকার মিল পর্যায়ে খোলা সয়াবিনের দাম ৯০ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন ১৩৫ ও খোলা সয়াবিনের দাম ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয় তখন বাজারে বোতলজাত সয়াবিন ১৪০-১৪৫ টাকায় ও খোলা সয়াবিন ১২০-১২২ টাকায় বিক্রি হয়।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৪৩ টাকা। ওই দরে বাজারে সয়াবিন পাওয়া যায়নি। পরে তা বাড়িয়ে নির্ধারণ হয় ১৬৮ টাকা। ওই দামেও তেল মেলেনি। ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে তেলের দাম কমিয়ে গত ২০ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে বোতলজাত সয়াবিন প্রতিলিটারের দাম ১৬০ টাকা ও খোলা সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৩৬ টাকা। তবে বাজারে বৃহস্পতিবার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৫-১৭০ টাকা ও খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ১৫৩-১৫৪ টাকা।
এদিকে এবার রোজা শুরুর ২০ দিন আগে নিত্যপণ্যের আমদানি বাড়াতে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার ও এলসি কমিশন ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু রোজায় এর সুফল পাওয়া যাবে না। কেননা এসব পণ্য দেশে আসতে কমপক্ষে ১ থেকে ৩ মাস সময় লাগবে। এগুলো বাজারজাত করতে আরও কমপক্ষে ১৫ দিন থেকে এক মাস সময় লাগে। এর পর উৎপাদন, আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ে ৩৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়। এর সুফল এখনো বাজারে পড়েনি।
টাউন হল কাঁচাবাজারের বণিক সমিতির একজন সদস্য বলেন, রমজান আসলেই বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে পণ্যমূল্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিভিন্ন সময় পণ্যের দর বেঁধে দেয়। কিন্তু এই বেঁধে দেওয়া দর কতটা যৌক্তিক তা তারা ভালো জানে। কারণ বাজার পরিস্থিতি ভিন্ন কথা বলে। তারা কীভাবে দর নির্ধারণ করে জানি না। তবে আমাদের পণ্য ক্রয় থেকে শুরু করে অতিরিক্ত পরিবহণ ভাড়া ও রাস্তায় চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সংগঠনকে চাঁদা দিতে হয়। সব মিলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। রমজান এলেই এ প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই রমজান আসার আগেই এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে দাম বেঁধে দেওয়ার পরও বিক্রেতারা ওই দামে বিক্রি করে না। সেজন্য মনিটরিং দরকার।
এদিকে প্রতিটি বাজারে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যমূল্যের তালিকা প্রতিদিন হালনাগাদ করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর মোহাম্মদী হাউজিং বাজারে দেখা গেছে, যেখানে পণ্যের মূল্য তালিকা লেখার বোর্ড রয়েছে এর আশপাশে ময়লার স্তূপ। বোর্ডে কোনো পণ্যের নাম ও মূল্য লেখা নেই।
এ বিষয়ে ৪-৫ বছর আগে কিছুটা তদারকি হলেও বর্তমানে হয় না বললেই চলে। বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, আগে লেখা হতো। এখন হয় না। এ বিষয়ে কেউ কোনো কিছু জানতে চাচ্ছে না। এছাড়া কাওরান বাজারে মূল ফটকের সামনে স্থাপিত মূল্য তালিকার বোর্ডে কোনো কিছুই নেই। নয়াবাজারেও একই অবস্থা।