ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব কমিউনিটি ক্লিনিক

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ১০:০০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৩৪ বার


স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব কমিউনিটি ক্লিনিক

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের মোছা. মোরশেদা বেগম। স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বামী ডা. আবু তাহের শহীদ হলেও এখনও স্বীকৃতি মেলেনি। সেই থেকে পুরো সংসারকে সামলে চলেছেন তিনি। এখন বয়স আশির কোটায়। কিন্তু  এক হাতে সামলেছেন পুরো সংসার।
এখন বয়সের ভারে ন্যুজ্ব এই বৃদ্ধা প্রায়ই ভোগেন নানা অসুখ-বিসুখে। সে সময় সময় ছেলে-নাতিদের মাধ্যমে স্থানীয় বাজার থেকে ট্যাবলেট এনে খেতেন। কিন্তু এখন কোনো অসুখ হলেই ছুটে যান কমিউনিটি ক্লিনিকে।
তার ভাষ্য, ‘বয়স বাড়ছে, ব্যথা-জ্বরের মতো অসুখ তো লাইগ্যাই থাহে। এমন কিছু (অসুখ) অইলেই আমরা বাড়ির পাশের হাসপাতালে যাই। হেইনো  (সেখানে) ডাক্তারেরা (স্বাস্থ্যকর্মী) দেইখ্যা-হুইন্যা (দেখে-শোনে) মাগনা (বিনামূল্যে) ওষুধ দেয়।’
‘এহন ওষুধের লাইগ্যা ট্যাকাও লাগে না। ছেলে-নাতিদেরও বিরক্ত করতে হয় না। এর লাইগ্যা আমরা শেখের মাইয়ারে (শেখ হাসিনা) ধন্যবাদ দেই, আল্লায় তারে বাঁচায়া রাহুইন (রাখুন),’ যোগ করেন মোরশেদা বেগম।
সরকার স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকে পাওয়া সেবার সন্তুষ্টির কথা এভাবেই বলছিলেন তিনি। বর্তমান সরকারের আমলে যেসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।  এ উদ্যোগ স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি বিল্পব। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতেও জনগণকে সচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
শুধু মোরশেদা বেগম-ই নন, ‘ফতেপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে’র স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে খুশি পাশের গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব তোতা মিয়া, তোফাজ্জল হোসেন, মোখলেছ শেখ, রাবেয়া বেওয়া, হাজেরা বেগমসহ ফুলপুর সদর ইউনিয়নের কয়েক গ্রামের মানুষ।
উপকারভোগীদের ভাষ্য, গ্রামাঞ্চলে আগে হাসপাতাল তো দূরের কথা, ভালো ওষুধের দোকানও পাওয়া যেত না। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগ ‘গরিবের হাসপাতালে’ পরিণত হয়েছে। এখন ঘরের কাছে বিনামূল্যে পরামর্শ ও ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে। আর এতেই স্বস্তি মিলেছে গ্রামীণ মানুষের জীবনে।
ক্লিনিকে প্রেসার মাপানোসহ স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিতে এসেছেন অন্তঃস্বত্তা শেফালী খাতুন। তিনি বলেন, প্রেসার মাপাতে এসেছে। আর গর্ভকালীণ সময়ের বিভিন্ন বিষয়ে এই হাসপাতাল থেকেই জানতে পেরেছি।
শেফালী খাতুন কলেন,‘এইখানের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার-সিএইচসিসিপি বেশ ভালো। তারা রোগীদের অসুখের খোঁজ-খবর নিয়ে ওষুধ দেন। ওষুধ কিনতেও টাকা লাগে না। এই হাসপাতাল হওয়ার আগে আমাদের এখন ফুলপুর কিংবা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়া লাগতো। এতে টাকা ও সময় লাগতো বেশি। কিন্তু এখন তা লাগে না,’ ।
সংশিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এরপর ২০০০ সালের এপ্রিলে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া পাটগাঁতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় সেখানকার গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ভরসাস্থল এই  হাসপাতাল। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় প্রকল্পটি আবারও চালু হয়। এরপর দ্রুত কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় ব্যাপকভাবে। ফলে অল্প সময়েই পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। এখন গ্রামীণ সড়কের পাশ দিয়ে প্রায়-ই চোখে পড়ে একেকটি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় একই নকশায় তৈরি ছোট্ট ভবনে এই ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা দিনে দিনে মানুষের কাছে অপরিহার্য ভরসা হয়ে উঠেছে।
জানা যায়, ‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ স্লোগানে পরিচালিত এসব ক্লিনিকের দেখভাল করেন স্থানীয় জনগণ। ফলে তৃণমূলে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সহজ হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ১৩ হাজার ৭০৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। প্রতিটি ক্লিনিকে একজন করে কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদ সৃষ্টি করে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ফতেপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় ৩-৪টি গ্রামের কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষকে এই ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। সর্দি-কাশি, জ্বরসহ সাধারণ রোগের ৩২ রকম ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
তিনি জানান, সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে। দিনে গড়ে ৭০-৮০ জন মানুষ পরামর্শ নিতে আসেন এই হাসপাতালে।
এদিকে কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য ২০০৯ সালের জুলাইয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প শেষ হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ২০১৮ সালের নতুন আইনের মাধ্যমে এই কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায়।
সূত্র জানায়, এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া ৩২ ধরনের ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা রয়েছে। শুরুতে কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেলিভারির ব্যবস্থা না থাকলেও পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো ক্লিনিকে ঘরের কাছে সহজে সন্তান প্রসবের নিরাপদ স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নাজনীন আকতার বলেন, কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামের একেবারে উপায়হীন একজন নারীকে সন্তান প্রসবের জন্য প্রচ- ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের বিপদ ও অদক্ষ দাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করছে। যা খুবই ভালো দিক। কেননা মা সুস্থ থাকলে, সন্তানও সুস্থ হবে। মা ও সন্তান সুস্থ থাকলে সুস্থ সমাজ হবে।
 ‘এই কার্যক্রম দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও রোল মডেল হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। আর গত ৫০ বছরে দেশের প্রকৃত গণমুখী কার্যক্রমের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা অনেক কিছু ছাপিয়ে ওপরে চলে গেছে,’ বলেন তিনি।
কমিউনিটি বেজড হেলথ সেন্টারের (সিবিএইচসি) মাস্টার ট্রেনার ডা. ইয়াসিন আলী বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এসব ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত মানুষ সেবা  নেন। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ভুকতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক প্রসব হয়েছে। যা একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
কমিউনিটি ক্লিনিকে পাওয়া সেবায় মানুষের সন্তুষ্টির কথা তুলে ধরে সিবিএইচসির লাইন ডিরেক্টর (ভারপ্রাপ্ত) মাসুদ রেজা কবীর বলেন, হাতের কাছে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পেয়ে সবাই খুশি। বর্তমানে ক্লিনিকগুলোতে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। ফলে মানুষের আস্থাও বেড়েছে।
এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে একদিকে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে, বেড়েছে আস্থা। তবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে অনেক ক্লিনিক ভবন। ফলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষের নানা ধরনের দুর্ভোগ হয়, এসব দিক পর্যবেক্ষণে নিয়েই নতুন মডেল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ।
এ বিষয়ে মাসুদ রেজা কবির বলেন, নতুন মডেলের প্রতিটি ভবনে চারটি করে রুম থাকবে, দুটিতে সেবাদানকারীরা বসবেন, একটি রোগীদের ওয়েটিং রুম, আরেকটি লেবার (ডেলিভারি) রুম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বাথরুম থাকছে দুটি।
‘এককথায় আধুনিক মানের একটি ক্লিনিক হিসেবে গড়ে উঠছে প্রত্যন্ত গ্রামের  ভেতরে থাকা এসব ক্লিনিক, যা বাস্তবায়িত হলে এখন যেসব ভোগান্তির অভিযোগ আছে তা দূর হয়ে যাবে,’ যোগ করেন তিনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি সাফল্য- উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আমাদের যে অর্জনগুলোকে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে-এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তার ফল।
‘ভবিষ্যতে এ সেবা কার্যক্রম সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের উদ্যোগসহ আরও কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’
এতে সাধারণ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র : বাসস


   আরও সংবাদ