ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৫ জুন, ২০২২ ১০:১৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪০৪ বার
একটি অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গ্রাহককে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। সারা বছরের আয় দিয়েও আয়কর সীমার মধ্যে আসে না এমন গ্রাহককেও ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু এ ক্রেডিট কার্ড নিতেও গ্রাহককে এখন আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এভাবে বিদ্যমান করের সাথে নতুন করে ব্যাংকিং খাতের ওপর করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের ওপর।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাতের ওপর বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়নি, বরং সাড়ে ৩৭ শতাংশ ট্যাক্সই বহাল রাখা হয়েছে। বহাল রাখা হয়েছে প্রভিশন ও সিএসআর কার্যক্রমের ওপর ট্যাক্স। ব্যাংকাররা জানান, নানা খাতে কর আরোপ করায় বছরে মোট আয়ের প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশই পরিশোধ করতে হয় নানা করের নামে। এক দিকেব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এ খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ এনে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। আবার এ প্রভিশনের ওপরও সরকারকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, ব্যাংক খাত বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নানাভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর করের খড়গ চাপানো হয়েছে। যেমনÑ ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ দিকে সব শ্রেণীর আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা ঋণের ওপর বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন দাখিলের রসিদ জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগে বাধ্যতামূলকভাবে কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) জমা দিতে হতো। এ কারণে গ্রাহকরা টিআইএনের কপি জমা দিয়ে ঋণ নিতো। তবে, বছর শেষে বেশির ভাগ টিআইএন ধারী রিটার্ন জমা দিতো না। কিন্তু এবার পাঁচ লাখ টাকার ঋণের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। এর ফলে আয়কর সীমার মধ্যে না থেকেও ন্যূনতম অর্থ জমা দিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে গ্রাহককে। রিটার্ন জমা না দিলে ঋণ নিতে পারবেন না গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকের ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণে ভাটা পড়ে যাবে বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।
এ দিকে ব্যাংকিং লেনদেনে কাগজের নোটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ক্রেডিট কার্ডে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই ক্রেডিট কার্ড প্রচলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, এ পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ লাখ। এ ২৫ লাখ গ্রাহকের মধ্যে বেশির ভাগের আয়ই ৩০ হাজার টাকার নিচে। সাধারণত ব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয় ২০ হাজার টাকার ওপরে হলেই সংশ্লিষ্টদের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে থাকে। আগে ক্রেডিট কার্ড নিতে টিআইএন লাগত। কিন্তু রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ক্রেডিট কার্ডের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ দিকে করোনায় ব্যাংকের আয় কমে গেলেও তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়নি। সাড়ে ৩৭ শতাংশ বহাল রাখা হয়েছে। যেখানে ব্যাংক বাদে অন্য কোনো লিমিটেড কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাদেরকে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। তুলনামূলক বেশি হারে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় সরাসরি কমে যায়। এ কারণে অধিক হারে মুনাফা করতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করে থাকে। নানা সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের পকেট থেকে কেটে রাখা হয় বাড়তি অর্থ।
বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্সের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের উৎসে কর আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যমান কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে আমানত রাখলে ১০ শতাংশ উৎসে আয়কর দিতে হতো। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে দিতে হবে ২০ শতাংশ। ব্যাংকাররা মনে করছেন, ব্যাংকের আমানতের বড় একটি অংশই প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। কিন্তু উৎসে আয়কর বাড়ানোর ফলে তাদের নিট আয় কমে যাবে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের আমানত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাবে। আর তা হলে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ আরো কমে যাবে। আমানত প্রবাহ কমলে কমবে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা। এ দিকে শুধু উৎসে আয়করই বাড়ানো হয়নি, পাঁচ কোটি টাকার ওপরের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের তারল্য প্রবাহে।
ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সার্কুলারের কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে গিয়ে প্রকৃত আয় কমে যায়। ব্যাংকারদের মতে, প্রভিশন ব্যাংকের বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। আয়কর আইনে বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টের ওপর অর্জিত আয়কর রেয়াতের সুবিধা পায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা বকেয়া অর্থাৎ ব্যয় হিসাবে আয়কর আইনে গণ্য করে না। এর ফলে একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১০০ কোটি টাকা হলে আর ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ ৬৫ কোটি টাকা হলে প্রকৃত আয় নেগেটিভ অর্থাৎ লোকসান গুনতে হয়। কারণ ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার ওপর সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাকি থাকে সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। এখন প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ৬৫ কোটি টাকা। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিট লোকসান হবে আড়াই কোটি টাকা।
এ দিকে ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমকে (সিএসআর) বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সিএসআর কার্যক্রম উৎসাহিত করতে ব্যাংকের বার্ষিক অর্থনৈতিক মানদণ্ডের সূচকে (ক্যামেলস রেটিং) সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যাংক যত বেশি সিএসআর করবে মানদণ্ডের সূচকে ওই ব্যাংক তত ভালো নম্বর পাবে। ব্যাংকারদের মতে, এ সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতাভুক্ত করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সিএসআর কার্যক্রম করলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে। যেমনÑ কোনো অন্ধকে ব্যাংক আর্থিক সুবিধা দিলে তার ওপর কোনো ছাড় নেই। কিন্তু এনবিআরের তালিকাভুক্ত কোনো অন্ধদের কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে দিলে তাতে কর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এরপরেও সাড়ে ৩২ শতাংশ সিএসআর কার্যক্রমে কর দিতে হচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, এতে দুই ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। প্রথমত, ব্যাংক সরাসরি প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সহায়তা করা হচ্ছে তারা শতভাগ সুবিধা পাচ্ছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতামুক্ত না করায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রম এড়িয়ে চলে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো শরিয়াভিত্তিক হওয়ায় ইসলামের পাঁচটি বাধ্যতামূলক পালনীয় স্তম্ভের অন্যতম জাকাত দিতে হয় ব্যাংকের আয়ের ওপর। ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রতি ১০০ টাকা আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হয়। কিন্তু জাকাতকে ব্যয় হিসাবে অর্থাৎ বকেয়াভিত্তিক হিসাব হিসেবে গণ্য করে না এনবিআর। এতে কোনো ব্যাংক পাঁচ কোটি টাকা জাকাত দিলে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হিসেবে এক কোটি সাড়ে ৮৭ লাখ টাকা কর দিতে হয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের ওপর যেকোনো ধরনের করারোপ করা হলে ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল থেকে তা পরিশোধ করে না। একপর্যায়ে তা জনগণের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়। যেমনÑ বিনিয়োগকারীদের নানা সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হয়। সবধরনের গ্রাহকের ওপর নানা ধরনের বাড়তি সার্ভিস চার্জ চাপানো হয়। সবমিলে শেষ পর্যায়ে সাধারণ জনগণকেই মাশুল দিতে হয়।