আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ৬ জুলাই, ২০২২ ১১:৫৫ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৪৫ বার
ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে জ্বালানি আমদানি। আগামীতে ডলারেও মিলবে না এ অপরিহার্য উপাদান। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাস বিক্রেতাদের ভান্ডারও ফুরিয়ে যাচ্ছে।
সরকারিভাবে তেল-গ্যাস আমদানির জন্য যাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হয়ে আছে তাদের অনেকে জানিয়ে দিচ্ছে, আগামীতে তারা আর জ্বালানি দিতে পারবে না।
তাদের ভান্ডারে পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উন্নত দেশগুলো আগামী ৫০ বছরের মজুত গড়ে তুলেছে। মজুতের পরও তাদের অর্ডার থামছে না। যার কারণে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো টাকা দিয়েও জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না।
এদিকে দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে দেশীয় গ্যাসের মজুতও। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম এতটাই বেড়েছে যে, সেখান থেকেও এখন আর গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না।
স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি আগে ক্রয় করা হতো ইউনিটপ্রতি (এমএমবিটিইউ) ২৫ ডলারে তা বেড়ে হয়েছে অন্য সব চার্জ মিলিয়ে ৫০ ডলার।
সিলেট গ্যাসফিল্ডস লিমিটেডের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র কৈলাসটিলা থেকে ২০১৬ সালে প্রতিদিন প্রায় ৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেটা নেমে এসেছে ২৯ মিলিয়ন ঘনফুটে।
এছাড়া ২০টি গ্যাসক্ষেত্রের বেশিরভাগ থেকেই আগের তুলনায় কম গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে, যার কারণে গ্যাসভিত্তিক প্রায় ৩ হাজার ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে আছে।
এর প্রভাবে দেশব্যাপী চলছে চরম লোডশেডিং। মঙ্গলবারও সারা দেশে ৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল। এদিন দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২শ মেগাওয়াটের মতো। সেখানে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৭৩ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ না থাকায় ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ শিল্পকারখানাগুলোকে দিনের বেলায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অপরদিকে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায়ও কারখানা চালু রাখা যাচ্ছে না। বারবার লোডশেডিং হওয়ায় পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখা যাচ্ছে না।
সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এটি ফোর্স লোডশেডিং। অর্থাৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বাড়লে লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন পড়ত না। তারপরও করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে লোডশেডিংয়ের অবস্থা তুলনামূলক বেশি খারাপ। অনেক জায়গায় দিনে ৪-৫ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছে না।
বিশেষজ্ঞ এবং পিডিবি সূত্র বলছে, সহসা কাটছে না এই সংকট। কারণ দিনে অন্তত ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কম সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। তাই সহসা লোডশেডিং থামবে বলে মনে করছেন না তারা।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি মার্কেট চরম অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
জাপানের মতো উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশও তাদের সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষকে নিয়মিত বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পারছে না। একই অবস্থা অস্ট্রেলিয়ারও। ভারত-পাকিস্তানের কথা না হয় নাইবা বললাম।
অর্থাৎ সবাইকেই এই সংকটকালীন সময়ে রেশনিং করতে হচ্ছে। দেশে বিদ্যমান কূপগুলো আরও গভীরে খনন করে গ্যাসের অনুসন্ধান চলছে। ৪৬টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নতুন করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, আশা করি এই পরিস্থিতি খুব বেশিদিন থাকবে না। এ বছরের মধ্যেই পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ভারত থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট আমদানিকৃত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এ পরিস্থিতিতে তিনি সবাইকে গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, ২৯ জুন দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল ৩ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট। তাতে আমদানি করা গ্যাস অর্থাৎ এলএনজি ছিল ৮৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এরপর থেকে প্রতিদিনই গ্যাস সরবরাহ একটু একটু করে কমানো হয়েছে। মঙ্গলবার গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ২ হাজার ৮২২ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি ৫০৭ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলা বলছে, মঙ্গলবার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৯১৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ২৯ জুন ছিল ১ হাজার ৮১ মিলিয়ন ঘনফুট। এই দুদিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমাতে দেখা গেছে। এই গ্যাস-রেশনিংয়ের ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হলে তেল বা কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানো হতো। ব্যয় কমাতে এবার তা-ও করা হচ্ছে না। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি।
যদিও সরকারি সূত্রগুলো দাবি করছে, স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সেখান থেকে কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এলএনজির নিয়মিত সরবরাহ চুক্তিতে কাতার এবং ওমান ট্রেডিংয়ের ওপর ভরসা করছে সরকার।
বর্তমানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য শিল্প মালিকরা গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
কারখানাগুলোর অনুমোদিত গ্যাসের চাপ হচ্ছে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট)। কয়েকদিন ধরে সেই চাপ ৭ পিএসআইর নিচে নেমে যাচ্ছে।
মালিকরা বলছেন, করোনার পর বর্তমানে দেশে তৈরি পোশাক কারখানায় প্রচুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। সেটি আগামী ছয় মাস পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে ধারণা করছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। এ অবস্থায় দেশব্যাপী লোডশেডিং ও গ্যাস সংকট এ সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয়ে ফেলে দেবে।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৩টি এবং ২টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অধীন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২০২১ সালে প্রতিদিন ২ হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয় দেশে।
অথচ ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন ২ হাজার ৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। ২০২২ সালে এসে এর সংখ্যা আরও অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য বলছে, দেশে মাত্র ৯-১০ বছর ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুত আছে।
দেশের বার্ষিক গ্যাস ব্যবহার প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রের মোট প্রামাণিক মজুতের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট, যা থেকে ইতোমধ্যে ২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, দেশের গ্যাসক্ষেত্রের মজুত ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
তবে কূপ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। বেশিরভাগ গ্যাসক্ষেত্রেই তা করা হয়নি। আমরা এমনও দেখেছি যে পরিত্যক্ত ঘোষণা দেওয়া কূপেও পরে গ্যাস পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকার নতুন কূপ অনুসন্ধানে বিনিয়োগের চেয়ে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সংকট কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছে সরকার। এটি দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে সেক্টরের ওপর অস্বাভাবিকভাবে জেঁকে বসেছে ভ্যাট ও শুল্ক। আগে এক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হতো ২৫০ ডলারে।
এখন প্রতি টনে শুধু শুল্কই দিতে হচ্ছে ২৩০ থেকে ৩শ ডলার। একই অবস্থা ডিজেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজিতেও। পরিস্থিতি সামলাতে জ্বালানি বিভাগ ভোজ্যতেলের মতো ডিজেল, ফার্নেস অয়েল এবং এলএনজি থেকে সব ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
অন্যথা ভয়াবহ ক্রাইসিসের দিকে যাবে দেশ। বন্ধ হয়ে যাবে কলকারখানার চাকা। এখন মজুত না বাড়ালে আগামীতে টাকা দিয়েও মিলবে না এই সম্পদ।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে সরকার জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা শুরু করেছে। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।
আগে যে ফার্নেস অয়েল টনপ্রতি ২৫০ ডলারে আমদানি করা হতো। এখন পড়ছে ৭০০ থেকে ১০০০ ডলার। আগে ২৫০ ডলারের ওপর ৩৪ শতাংশ ডিউটি দিতে হতো।
এখন পুরো ১০০০ ডলারের ওপর ডিউটি দাঁড়াচ্ছে ২৩০ থেকে ৩শ ডলার, যা প্রায় আগের আমদানি মূল্যের সমান। জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে তার চেইন ইফেক্ট অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়।
তেলের দাম বেড়ে গেলে সেচের খরচ বাড়বে, সেচের খরচ বাড়লে চালের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। বেড়ে যাবে পরিবহণ খরচ। এতে উৎপাদনের পাশাপাশি সরবরাহ চেইনও বিঘ্ন হবে।
মারাত্মক সংকট তৈরি হতে পারে। এ কারণে অন্তর্বর্তীকালের জন্য হলেও ডিউটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের জন্য হাহাকার পড়ে যেতে পারে। কারণ উন্নত দেশগুলো আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মজুত তৈরি করেছে। যার কারণে এখন টাকা দিলেও তেল-গ্যাস পাওয়া যাবে না।
বিইআরসিতে দাখিলকৃত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়াতে হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলে আগে শুল্ক ও কর অব্যাহতি ছিল।
কিন্তু জুনে ফার্নেস অয়েলে শুল্ক-কর আরোপ করায় খরচ ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরে শুধু জ্বালানি বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩ টাকা ১৬ পয়সা জ্বালানি খরচ হয়। আগের অর্থবছর ২০১৯-২০ এই ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিটে ২ টাকা ১৩ পয়সা।
অন্যদিকে গ্যাসের উৎপাদন ঘাটতি থাকায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। যার দাম এখন আকাশচুম্বী।
এলএনজির ইউনিটপ্রতি প্রকৃত ক্রয়মূল্য (মার্চে) ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে। গ্যাস সেক্টর বলছে, দাম না বাড়ালে তাদের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে ২০২২ সালে।