ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৪ জুলাই, ২০২২ ০৯:৩৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪০৯ বার
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেওয়া অর্থ বাদ দিলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পরিমাণ আরও কম। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি দায় বাবদ ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। রপ্তানি আয় থেকে ৪ বিলিয়ন ও রেমিট্যান্স থেকে ২ বিলিয়নের কিছু কম পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে। ফলে প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক না হলে আমদানির এই চাহিদা সহসাই কমবে না। অন্যদিকে রপ্তানি অর্ডার কমছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। আবার রেমিট্যান্স প্রবাহও আগের চেয়ে কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় ও ব্যবস্থাপনায় আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই; কিন্তু সেগুলোর প্রভাব এখনই পড়বে না। এ জন্য বিকল্প উদ্যোগও নিতে হবে। বিশেষ করে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক, আমদানি অর্থায়নের সুদহার বাড়ানো, ব্যাংকগুলোর ওপেন পজিশন কমানো ও বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে বহুজাতিক সংস্থা থেকে সহজ শর্তে বাজেট সহায়তা নেওয়া ও জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত চাপে রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে দেশের অর্থনীতির শক্তির পরিচায়ক এই অন্যতম সূচকের সামর্থ্য। অবশেষে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে। গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪০ বিলিয়নের নিচে নামল। মজুত কমে আসায় সরকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত যেসব উন্নয়ন প্রকল্পে আমদানি ব্যয় আছে, সেগুলো ধীরে বাস্তবায়নের নীতি নেওয়া হয়েছে। গাড়ি কেনা বন্ধ এবং বিদেশ ভ্রমণ বাবদ বরাদ্দের অর্ধেক খরচ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকশ বিলাসপণ্য ও জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক্ক বাড়িয়েছে সরকার। গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন তথা এলসি খোলার সময় নগদ জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মার্জিনের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে ঋণের টাকায় মার্জিন নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বর্তমানে আন্তঃব্যাংকেই প্রতি ডলারের দর উঠেছে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। এক বছর আগে যা ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা ছিল। এ ছাড়া সরকার আইএমএফ থেকে তিন বছর মেয়াদে সাড়ে চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে ৪০ বিলিয়নে নেমে গেছে কয়েক মাসের মধ্যে। এটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। তবে বাংলাদেশ কোনো দুর্যোগে পড়েছে, সে রকম নয়। কিন্তু রিজার্ভ কমে আসায় টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। এতে বিনিয়োগ কমবে। মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। তবে টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে বিনিময় হার বেঁধে দেওয়া ঠিক হবে না। এ জন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রপ্তানি আয় সময়মতো প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ইডিএফ তহবিলের ঋণ সময়মতো ফেরত আসা নিশ্চিত করতে হবে। মুদ্রা পাচার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর নেট ওপেন পজিশন কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শতভাগ রপ্তানিমুখী খাতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার সুযোগ রেখে অন্য ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪০ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও প্রকৃত মজুত ৩২ বিলিয়ন ডলার। আমদানি ব্যয়ের বিবেচনায় এই মজুত দিয়ে সাড়ে চার মাস চলা যাবে। এর সঙ্গে সেবা খাতের দায় পরিশোধ, সরকারি-বেসরকারি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ যোগ করলে আমদানি দায়ের জন্য আরও কম রিজার্ভ থাকবে। তবে এখন পর্যন্ত রিজার্ভের লেভেল ঠিক আছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে- এটা আশঙ্কাজনক। রিজার্ভ যাতে না কমে, সে জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাই আমদানি অর্থায়নের সুদহার ও মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। সেবা খাতে দায় কমানোর চেষ্টা করতে হবে। বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। এগুলো করা কঠিন। তবে সরকার যত দ্রুত করবে, ততই মঙ্গল।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সেসব উদ্যোগের প্রভাব এখনই লেনদেনের ভারসাম্যে পড়বে না। যে কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে পর্যায়ে নেমেছে, সেটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো না হলেও সতর্ক হতে হবে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা করতে হবে। সরকার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ থেকে বাজেট সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সহায়তা যত দ্রুত নেওয়া যাবে, ততই ভালো। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজার ও বাস্তবভিত্তিক করতে হবে। এখন যেভাবে চলছে, তাতে আন্তঃব্যাংক বাজার প্রকৃতপক্ষে কাজ করছে না।