আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬ জুলাই, ২০২২ ১৬:০৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৫১ বার
শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সব ধরনের সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে রাজাপক্ষের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। এক সপ্তাহ আগে কলম্বোর রাস্তায় কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীরা গোতাবায়া রাজাপক্ষের রাজপ্রাসাদ ও কার্যালয় দখল করেন। বিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রথমে মালদ্বীপ ও পরে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান।
স্থানীয় সময় আজ শনিবার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পার্লামেন্টে অধিবেশন বসেছে। অধিবেশনে পার্লামেন্টের সেক্রেটারি জেনারেল আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের পদ শূন্য হয়েছে। সেক্রেটারি জেনারেল ধামিকা দাসানায়েকে অধিবেশনে গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগপত্র পড়ে শোনান। তিনি পার্লামেন্ট হাউসকে বলেন প্রেসিডেন্টের পদ শূন্য রয়েছে।
পার্লামেন্টের সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, ১৯ জুলাই স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় পার্লামেন্ট আহ্বান করলে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনয়ন জমা দিতে হবে। একজনের বেশি প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলে ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য পার্লামেন্টে ভোট অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান তিনি। তত দিন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ও রাজাপক্ষের মিত্র ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করবেন।
শ্রীলঙ্কার জ্বালানিমন্ত্রী কাঞ্চনা বিজেসেকেরা বলেন, স্থানীয় সময় আজ দেশটিতে প্রথমবারের মতো জ্বালানির তিনটি চালান এসে পৌঁছেছে। ডিজেলের দ্বিতীয় চালানও আজ এসে পৌঁছাবে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে পেট্রলের চালান এসে পৌঁছাবে। তিনটি চালানের জন্যই দাম পরিশোধ করা হয়েছে বলেও জানান জ্বালানিমন্ত্রী।
এদিকে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা জারি করা হয়েছে। শতাধিক পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মী সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ ঠেকাতে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জলকামান ব্যবহার করছে।
সব মিলে শ্রীলঙ্কা এখন নজিরবিহীন এক সংকটে রয়েছে। সেদিকে ফিরে তাকাব আমরা।
চড়াই-উতরাই
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিকে নানা সংঘাত, সহিংসতা, সংকট, চড়াই-উতরাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চল ঘিরে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল লিবারেশন অব তামিল টাইগার্স ইলম (এলটিটিই) নামের সংগঠন। দেশটির সরকারকে বহু বছর ধরে এলটিটিইর সশস্ত্র তৎপরতারমোকাবিলা করতে হয়।
২০০৯ সালে রক্তক্ষয়ী এই লড়াইয়ের অবসান ঘটে। তামিল টাইগার গেরিলাদের দমনের অভিযান তত্ত্বাবধান করেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া। এই গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ২০১৯ সালে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কা। ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার একাধিক স্থানে জঙ্গি হামলা হয়। এই হামলায় আড়াই শর বেশি মানুষ নিহত হয়।
রাজাপক্ষে পরিবারের প্রভাব
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে রাজাপক্ষে পরিবার। এই পরিবারের সদস্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট—উভয় পদেই দায়িত্ব পালন করেন।
মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া দেশটির সবশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁদের আরেক ভাই বাসিল রাজাপক্ষে ছিলেন অর্থমন্ত্রী।
মাহিন্দা ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলে রাজনীতিতে নামেন গোতাবায়া। তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। তামিল টাইগার গেরিলাদের দমনের দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। গৃহযুদ্ধ শেষ করায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের চোখে নায়ক বনে যান তিনি।
২০১৫ সালে মাহিন্দা ক্ষমতা হারান। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ ছাড়েন গোতাবায়া। ২০১৯ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর ক্ষমতায় ফেরে রাজাপক্ষে পরিবার। একজন দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না—এ নিয়মের কারণে মাহিন্দা তখন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হন গোতাবায়া।
২০২০ সালে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাড়ে গোতাবায়ার দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি)। সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পায় দলটি। প্রধানমন্ত্রী পদে ভাই মাহিন্দাকে বসান গোতাবায়া। আরেক ভাই বাসিলসহ আত্মীয়দের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন তিনি।
অর্থনৈতিক সংকট
২০১৯ সালের শেষ দিকে গোতাবায়া জনতুষ্টিমূলক কর কর্তনের পদক্ষেপ নেন। এতে সরকারের রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়। করোনা মহামারিতে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মক ধাক্কা খায়। এতে দেশটির স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে।
শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়। আমদানি করা পণ্য ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয়।
বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খেতে থাকে শ্রীলঙ্কা। এই ঋণের বড় অংশই ছিল উচ্চাভিলাষী অবকাঠামাগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ। এমনকি ভারতের মতো প্রতিবেশীর কাছেও দেনাদার হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা।
অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিবাদ জানাতে চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশটির জনগণ রাজপথে নামে। সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ দমনে মাঠে নামেন রাজাপক্ষেদের সমর্থকেরা। বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক সংকট
চলতি বছরের গত৩১ মার্চ শত শত বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে তাঁর বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় গোতাবায়া ১ এপ্রিল দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
৩ এপ্রিল গভীর রাতে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য ইস্তফা দেন। এতে গোতাবায়া-মাহিন্দা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ৪ এপ্রিল দেশটির বিরোধীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয় সরকার। কিন্তু বিরোধীরা তা নাকচ করেন।
৯ এপ্রিল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন হাজারো মানুষ।
১২ এপ্রিল সরকার ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণখেলাপির ঘোষণা দেয়। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষের দিকে বলে জানানো হয়।
১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার নতুন সদস্য নিয়োগ দেয় সরকার। তবে এই সরকারেও মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাখেন গোতাবায়া।
টানা কয়েক সপ্তাহের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ১৯ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২৮ এপ্রিল দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটে থমকে যায় শ্রীলঙ্কা। ৬ মে আবার ধর্মঘট ডাকা হয়। এদিন আবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
৯ মে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান সরকার-সমর্থকেরা। বিক্ষোভকারীরাও পাল্টা হামলা করে। সংঘর্ষের পর মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার ওপর চাপ আরও বাড়ে। তিনি একা হয়ে পড়েন।
সংকট উত্তরণে রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১২ মে তিনি শপথ নেন। এর আগে তিনি পাঁচবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
৯ জুলাই সরকারবিরোধী বিক্ষোভ নাটকীয় মোড় নেয়। এদিন বিক্ষোভকারীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়েন। তার আগেই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছাড়েন গোতাবায়া। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই নেতা পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেন।
গোতাবায়ার পলায়ন : গণবিক্ষোভের মুখে ১২ জুলাই রাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে মালদ্বীপে যান গোতাবায়া। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় রনিলকে। এই পদক্ষেপে দেশটিতে জনরোষ আরও বাড়ে।
১৩ জুলাই শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করেন রনিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার নির্দেশ দেন তিনি। এদিন ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হামলা চালান। কার্যালয় দখলে নেন। তাঁরা অবিলম্বে রনিলেরও পদত্যাগ দাবি করেন। দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জানান।
১৪ জুলাই মালদ্বীপ থেকে সিঙ্গাপুরেযান গোতাবায়া। গোতাবায়া সিঙ্গাপুরে গিয়ে ১৪ জুলাই শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের কাছে ই-মেইলে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। ১৫ জুলাই গোতাবায়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন দেশটির পার্লামেন্ট স্পিকার। একই সঙ্গে রনিল দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, কলম্বো গেজেট, ডেইলি মিরর শ্রীলঙ্কা, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এএফপি