ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

বিনিয়োগ নিয়ে সতর্ক: জুলাই-অগাস্টে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ‘পিছুটান’

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১০ অক্টোবর, ২০২২ ১১:১৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ২৮৪ বার


বিনিয়োগ নিয়ে সতর্ক: জুলাই-অগাস্টে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ‘পিছুটান’

ডলারের চাপ সামলাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপের প্রভাবে বিদেশ থেকে পণ্য আনার ঋণপত্র বা এলসি খোলার ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পড়েছে; তবে মূলধনী যন্ত্রপাতির পাশাপাশি কাঁচামাল আসা কমেছে উল্লেখযোগ্যহারে, যেটিকে ভবিষ্যত বিনিয়োগের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। 

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্টে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নতুন এলসি খোলার তথ্যই বলছে, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কতটা দেখেশুনে এগোচ্ছেন। তাদের অতি সাবধানতার ফল হিসেবে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রধান এ পণ্য আমদানি খাতে এলসি খোলা কমেছে কমেছে ৬৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। 

এর প্রভাবেই মূলত দেশের মোট আমদানিতে নতুন এলসি খোলার ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা ধীর হয়েছে; বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ। এ সময়ে মোট নতুন এলসি খোলা হয়েছে ১২৪০ কোটি ডলারের। 

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিকে দেশে নতুন বিনিয়োগ বা বিনিয়োগ সম্প্রসারণের প্রধান নির্দেশক হিসেবে ধরা হয়। 

সেই বিবেচনা থেকে অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডলারের উচ্চ মূল্য এবং মূল্যস্ফীতির মত বর্তমানের অস্থিতিশীল পরিবেশে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবে না বলেই মনে করছেন। 

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, “মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি মানেই নতুন বিনিয়োগ। অর্থনীতির এই অস্থিরতার মধ্যে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণ করছেন।” 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট প্রথম দুই মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের ১১৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার থেকে ৭৫ কোটি ৩৬ লাখ ডলার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলারে। 

এসময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানিতেও এলসি খোলা কমেছে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৯৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার থেকে কমে হয়েছে ৯৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। 

একইভাবে জুলাই-অগাস্ট সময়ে কাঁচামাল আমদানির এলসি ৪৭৩ কোটি থেকে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৪৪১ কোটি ডলার।

এ তিন তথ্যই বিনিয়োগ নিয়ে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সাবধানতার জানান দিচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা বলছেন। তাদের মতে, আরেকটি বিশ্ব মন্দার আশঙ্কার মধ্যে কেউ এখন ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতির পেছনে ১০৫ টাকার বেশি দিয়ে প্রতি ডলার কিনতে চাচ্ছেন না। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্যই অপেক্ষা করছেন। 

এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির গতি ঠিক রাখতে মূল্যস্ফীতি কমানো ও রিজার্ভ ধরে রাখতে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর। বাজারে মূদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর পরামর্শও এসেছে। 

নতুন বিনিয়োগকে ‘টেনে ধরেছে’ ডলার 
করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে উঠার পর অর্থনীতি সক্রিয় হতে শুরু করলে সব ধরনের পণ্য আমদানি বাড়তে থাকে। এরমধ্যেই ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার চড়তে থাকে; জ্বালানি তেলসহ সবকিছুই হয়ে পড়ে ঊর্ধ্বমুখী। বৈশ্বিক এ প্রভাবের ঢেউ লাগে বাংলাদেশেও; ডলারের চাহিদা ও দর হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। মূল্যস্ফীতির পারদও চড়তে থাকে সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। 

আমদানি বাড়ার বিপরীতে আশানুরূপ রপ্তানি ও রেমিটেন্স না আসায় ডলার ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি দেখা দেয়। এতে চাপ তৈরি হয় রিজার্ভে। ডলারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে দিনের পর দিন ডলার বিক্রি করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায় বাংলাদেশ ব্যাংক। 

এতে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে ব্যাংকে ১১১ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়; খোলা বাজারে কেনাকাটা হয় ১২১ টাকাতেও। এরপরই বাধ্য হয়ে এপ্রিল থেকে আমদানিতে লাগাম টানতে কড়াকড়ির পথে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একের পর এক নতুন নির্দেশনা ও নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

সব ধরনের উদ্যোগ শেষ সবশেষ ব্যাংকারদের সঙ্গে আলোচনায় দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা আন্তব্যাংক ডলারের বিনিময় মূল্য ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে এখন আমদানিতে ডলারের দর ১০৪ থেকে ১০৭ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। 

এসব কারণেই যে কোনো ধরনের নতুন পণ্য আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। 

ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি বন্ধ রয়েছে। উচ্চ মূল্য থাকায় আমদানি কমিয়ে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা আর সরকারও অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ এনেছে। 

“মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হলে আগামী বছর ফের আমদানি বাড়তে বাড়তে পারে। এই বছরে খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে করছি না।” 

নতুন এলসি কমলেও নিষ্পত্তি বেড়েছে 
ডলার সাশ্রয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক পদক্ষেপ ও নজরদারি বাড়ানোর প্রভাব নতুন এলসির খোলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে যে উল্লম্ফন্ন দেখা দেয় তাতে লাগাম পড়েছে। আমদানির উচ্চ গতি ধীর হয়েছে। গত অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য মোট ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি খোলা হয়েছিল, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি ছিল। 

ঊর্ধ্বমুখী এ ধারার বিপরীতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্টে নতুন এলসি খোলার হার খুবই সামান্য বেড়েছে। গত বছরের এই সময়ে নতুন এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ২৩৫ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের, যা চলতি বছরে মাত্র শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২৪০ কোটি ৮২ লাখ ডলার। 

এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির এলসি। টাকার অঙ্কে তা ১৮৭ কোটি ডলারের, গত অর্থবছরের এ সময়ে যা ছিল ১০৪ কোটি ডলার। এর বিপরীতে এসময়ে সবচেয়ে বেশি ৬৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি।

নতুন এলসি খোলার মত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এসময়ে এলসি নিষ্পত্তিও সবচেয়ে বেশি ১১৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছে পেট্রলিয়াম পণ্যের। চলতি অর্থবছরে ২২৭ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। 

আর সব পণ্যের মোট এলসি নিষ্পত্তির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলিত অর্থবছরের জুলাই-অগাস্টে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের (১ হাজার ৭৫ কোটি) চেয়ে ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।

মূলধনী যন্ত্রপাতিতে নতুন এলসি কমলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ খাতে নিষ্পত্তি পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বেড়েছে। গত অর্থবছরের এসময়ের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৬৩ কোটি ডলার থেকে চলতি অর্থবছরে তা হয়েছে ৯৭ কোটি ডলার। 

এলসি নিষ্পত্তির অর্থ হল- পুরনো যেসব এলসি খোলা হয়েছিল তার দায় মেটানো হচ্ছে এখন। এতে আমদানির জন্য এখন ডলারের খরচ আরও বেড়েছে গত অর্থবছরের তুলানায়। 

এ বিষয়ে আহসান মনসুর বলেন, “এটি ভালো দিক যে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমে আসছে এখন। তবে পেমেন্ট বেড়ে চলছে। এখন যে পেমেন্ট হচ্ছে তা গত ৩-৪ মাস আগ থেকে এক বছরের পুরনো এলসি। নতুন এলসি খোলার পরিমাণের প্রভাব দেখতে পাব আরও কয়েক মাস পরে। 

“আশা করছি, অক্টোবরের শেষের দিকে পেমেন্টের পরিমাণ কিছুটা কমে আসতে পারে।”

এদিকে রপ্তানি ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ার বিপরীতে বেশি পরিমাণে আমদানি দায় পরিশোধে রিজার্ভ কমে গত ৪ অক্টোবর ৩৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়নে নেমেছে। গত অর্থবছরের এই সময়ে যা ছিল ৪৬ দশমিক ২৪ বিলিয়ন।


   আরও সংবাদ