ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারী, ২০২৩ ১১:১৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩২৪ বার
শিশুটির বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেন তার মা। এমনই এক বাড়ির দারোয়ান ২০১৯ সালে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। তারপর মামলার বিভিন্ন স্তরে থানা, আদালত—প্রায় সব জায়গায় শিশুটিকে বারবার ঘটনার বয়ান দিতে হয়েছে। নারী পুলিশ কনস্টেবল পর্যন্ত বলেছেন, ও দারোয়ানের কাছে গেল কেন? ও মনে হয় একটু পুরুষঘেঁষা। বাচ্চাটা সুন্দর, পুরুষ একা পেলে তো এমন করবেই, মা কেন একটু চোখে চোখে রাখলেন না।
কথাগুলো বললেন ধর্ষণের শিকার শিশুটির এক স্বজন। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ধর্ষণের শিকার বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় যে মেয়ে ও নারীরা, ঘটনায় তাদের নিজেদেরও দোষ আছে, এটা মনে করেন শতকরা ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নারীর প্রতি সহিংসতা কর্মসূচির আওতায় বেসরকারি সংস্থা ডি-নেট দেশব্যাপী এ গবেষণা পরিচালনা করে।
গবেষণায় মানুষের যে ধারণা পাওয়া গেছে, তার একধরনের আইনি বৈধতাও আছে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী আদালতে তার চর্চাও হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনায় বিবাদীপক্ষের আইন সংশ্লিষ্টরা এ পুরোনো আইনের ধারাকেই সামনে এনে ধর্ষণের শিকার নারী বা ভিকটিমকে হেনস্তা করেন।
আদালতে একগাদা মানুষের সামনে ধর্ষণের শিকার নারীকে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাঁর চরিত্র এবং অতীত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি প্রমাণ করতে চান, তাঁর চরিত্র ভালো নয় বলেই তাঁর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে। আর ধর্ষণের শিকার শিশু হলে সে খেলতে গিয়ে বা অন্য কোনোভাবে যৌনাঙ্গে আঘাত পেয়েছে তা প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠেন আইনজীবী। তারপর শুরু করেন শিশুটির মায়ের সঙ্গে অভিযুক্ত ধর্ষকের সম্পর্ক খোঁজা, চক্রান্তের গল্প ফাঁদা।
কথাগুলো বললেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার। এ কেন্দ্র থেকে ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসা, আইনি সেবাসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়।
ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের জন্য হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌনপীড়নের ছয়টি অপরাধে ঢাকার পাঁচটি বিশেষ আদালতে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে প্রথম আলো। ১৫ বছরে আসা মামলাগুলো ধরে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ২০১৮ সালে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগকারীকে থানা থেকে আদালত পর্যন্ত অশেষ হয়রানি পোহাতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় লোকলজ্জা আর ধিক্কারের। থানা ও আদালতের পরিবেশ, ‘চরিত্রহীন’ প্রমাণের চেষ্টা, ডাক্তারি পরীক্ষা—এসব ধর্ষণের অভিযোগকারীকে বিপর্যস্ত করে। অবিশ্বাসের মুখোমুখি হতে হয়। নিতান্ত মরিয়া না হলে কেউ মামলা করতে আসে না।
তথাকথিত টু ফিঙ্গার টেস্ট বা ‘দুই আঙুলি’ পরীক্ষায় যোনিপথের প্রবেশযোগ্যতা ও পর্দার (হাইমেন) অবস্থা দেখার অবমাননাকর পদ্ধতিকে হাইকোর্ট একটি রায়ে নিষিদ্ধ করেছেন। ২০১৮ সালে দুই-আঙুলি পরীক্ষা-সংক্রান্ত রায়ে হাইকোর্ট বিচারিক আদালতকে নিশ্চিত করতে বলেছেন, ভুক্তভোগীকে যেন অবমাননাকর প্রশ্ন করা না হয়।
আদালতে ধর্ষণের ভিকটিমকে অবমাননাকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না
নারী অধিকার আন্দোলনকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে আইনে নারীর প্রতি অবমাননাকর ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। অবশেষে গত ১৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এভিডেন্স অ্যাক্ট বা সাক্ষ্য আইনের (সংশোধন) খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীকে জেরা করার ক্ষেত্রে শালীনতা বজায় রাখতে হবে। অবশ্য কোন জাতীয় প্রশ্ন করা প্রয়োজন, সেটি আদালত ঠিক করে দেবেন। আইনের খসড়ায় মামলার বিচারে ডিজিটাল তথ্যপ্রমাণ গ্রহণ করা যাবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদিত আইনের খসড়ায় সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারাটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।’ অর্থাৎ ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগকারীকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করে তার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে।
সাক্ষ্য আইনের ১৪৬(৩) ধারায় বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করার জন্য সাক্ষীর চরিত্রকে আঘাত করতে পারে, এমন প্রশ্ন আরোপ করার অনুমতি দেওয়া আছে। সাক্ষ্য আইনের অনুমোদিত খসড়ায় শর্ত আরোপ করে বলা হয়েছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ ধারা অনুযায়ী ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
ধর্ষণসংক্রান্ত আইনে ভিকটিমের পক্ষ হয়ে লড়াই করা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, খসড়া আইনে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তা আইনে পরিণত হলে এবং বাস্তবায়িত হলে ধর্ষণের ভিকটিম আদালতে হেনস্তার হাত থেকে রেহাই পাবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আলী আসগর বলেন, আইনে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তাকে নারী আন্দোলনের বড় একটি অর্জন বলা যায়। এ জন্য সরকারকেও ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন। ধর্ষণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও ভিকটিম যৌনকর্মী কি না, আগে কয়টা বিয়ে করেছেন, এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতেন। এখন যে সংশোধনীর কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে মামলা সংশ্লিষ্ট ছাড়া কোনো প্রশ্ন আইনজীবীরা করতে পারবেন না। ধর্ষণ পরীক্ষায় একসময় ‘হেবিচুয়েট’ বা অভ্যস্ত কথাটি লেখা হতো। এখন তা বাতিল করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ভিকটিমের জন্য অবমাননাকর টু ফিঙ্গার টেস্টও বাতিল করা হয়েছে। পুরুষ চিকিৎসক ভিকটিমের ফরেনসিক পরীক্ষা করতে পারবেন না—এ বিষয়টিও কার্যকর হয়েছে। কেউ আবেদন করলে বা আদালত নিজের বিবেচনায় ধর্ষণসংক্রান্ত মামলার শুনানি একান্তে রুদ্ধদ্বার ঘরে করতে পারেন। এসব অর্জনের ধারাবাহিকতায় আইনের সংশোধনীটি এসেছে। এখন আইনে পরিণত হলে তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়, তার ওপর নির্ভর করছে এর সফলতা বা ব্যর্থতা।
লিঙ্গবৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক ঘোষণাপূর্বক সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ও ১৪৬(৩) ধারা বাতিল চেয়ে গত বছরের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও নারী অধিকারবিষয়ক সংগঠন নারীপক্ষ রিট করে। এ তিন সংগঠনের পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট আইনজীবী সারা হোসেন। রিটে আইন মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করা হয়। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের সাক্ষ্য আইনের খসড়া (সংশোধনী) অনুমোদন পেল।
ব্লাস্টের উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তাজুল ইসলাম জানালেন, আইনের ৫৩ ধারা, ধারা ১৫০–সহ সাক্ষ্য আইনের যেসব ধারায় ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে যাচ্ছে, সেগুলোও সংশোধনে জোটের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান থাকবে।