আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারী, ২০২৩ ১০:০২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ২৯৮ বার
পশ্চিমা বিশ্বে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ইসলামভীতি বা মুসলিম বিদ্বেষ। শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে কোনো অপরাধ না করেও অনেককে মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সামগ্রিকভাবে শান্তির বার্তা বহন করলেও ‘ইসলামভীতি’ ছড়ানোর বিষয়টি অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; যার জন্য বহুলাংশে দায়ী পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু এর কারণটা কী!
সম্প্রতি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের সামনে পবিত্র কুরআনে আগুন ধরিয়ে দেন উগ্র ডানপন্থি নেতা রাসমুস পালুদান। পুলিশ তাকে এ কাজে বাধা দেয়নি; বরং এতে তাদের সমর্থন ছিল বলে অভিযোগ ওঠেছে। কেননা পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যেই এ কাজটি করেন পালুদান। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কেননা সুইডিশ-ড্যানিশ ওই নাগরিক আগেও এমন অপরাধ করেছে। গত বছরের এপ্রিলে রমজানে পালুদানের কুরআন পোড়ানোর ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি হয়। সে সময় তিনি সুইডেন সফরের সময় প্রকাশ্যে কোরআন পুড়িয়েছিলেন।
সুইডেনের এমন পদক্ষেপে ক্ষোভে ফুঁসছে মুসলিম বিশ্ব। দেশে দেশে চলছে সুইডেনবিরোধী বিক্ষোভ। ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান। গত ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান জানান, ন্যাটো জোটের সদস্যপদ পেতে সুইডেনকে কোনো ধরনের সমর্থন দেবে না তুরস্ক।
অন্যান্য রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের মতো সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসনও এ ঘটনার নিন্দা জানান। তবে এরই মধ্যে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে সুইডেনের। আগে থেকেই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয় তুরস্কের। এরই মধ্যে কুর্দি কর্মীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তুরস্কের ক্ষোভের মুখে রয়েছে সুইডেন। তারপর ঘটল কুরআন পোড়ানোর মতো ঘৃণ্য ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের পর থেকেই মুসলিম বিদ্বেষ ও ইসলামভীতি বাড়তে শুরু করে। দিনে দিনে তা আরও গাঢ় হয়। এমনিতেই ইউরোপের দেশগুলো মুসলিমবিরোধী গোষ্ঠীসহ অভিবাসীবিরোধী অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ এবং মোকাবিলায় কঠোর নীতি মেনে চলে। রাজনৈতিক প্রচারণা এবং দৈনন্দিন বক্তৃতায় ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি ধীরে ধীরে সাধারণ বিষয় হয়ে উঠছে এসব দেশে।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম হওয়া মানেই যেন পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল, চরমপন্থি কিংবা নারী স্বাধীনতাবিরোধী। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচারণার অস্ত্র করেছিলেন ইসলামকে। ছড়িয়েছিলেন মুসলিমবিরোধী নানা অপপ্রচার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিমবিরোধী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি। তার শাসনামলে মুসলিম পরিচয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের ধারাবাহিক বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। তবে বিপরীত বিষয় হলো, ট্রাম্প কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে ঠিকই ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনও একই নীতি অনুসরণ করছেন, যার নেপথ্যে রয়েছে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপীয় নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামভীতি আবারও বাড়িয়ে তুলছে। তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য জনগণকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে। বাকস্বাধীনতার সঙ্গে বিভ্রান্তিকর উসকানি এ ক্রমবর্ধমান হুমকিকে মোকাবিলা করা কঠিন করে তুলেছে।
ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে অপপ্রচারের কারণে বিভ্রান্তিও বাড়ছে। গত বছর কানাডার কুইবেক শহরের মসজিদে গুলি করে ছয় জন মুসলিমকে হত্যার ঘটনা ঘটে। এতে স্থানীয় কট্টরপন্থি রেডিও স্টেশনগুলো তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। ওই অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেও তখন রেডিও স্টেশনগুলোর সমালোচনা করেন। স্থানীয়ভাবে এই স্টেশনগুলো ‘ট্র্যাশ রেডিও’ নামে পরিচিত। এই রেডিও স্টেশনগুলো টক শো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় সমাজে ইসলামভীতি ছড়াচ্ছিল।
পৃথিবীর কোনো দেশে সন্ত্রাসী হামরা ঘটলে প্রথমেই মুসলিমদের ওপর তার দায়ভার চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলেছে, তার বেশিরভাগই চালিয়েছে অমুসলিমরা।
‘লোনওয়াচডটকম’ নামে একটি ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ০. ৪ শতাংশ ঘটেছে মুসলিমদের দ্বারা। বাকি ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে অমুসলিম বা অন্য ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা। ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে তার ৬ শতাংশ মুসলিম নামধারীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। বাকি ৯৪ শতাংশের জন্য দায়ী অন্য জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে কখনো কখনো কিছু জঙ্গি সংগঠন নিজেদের ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করে। কিন্তু আসলেই কি তারা মুসলিম? তারা হয় বিভ্রান্তির পথে আছে, নয়তো জেনে বা না জেনে অন্য কোনো গোষ্ঠীর প্ররোচনায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
ইউরোপের দেশগুলোতে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত একটি সার্বজনীন দলিল দ্বারা স্বীকৃত। ইউরোপের অনেক দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন আইন করা হয়েছে। এসব আইন যদিও মুসলিমদের সুরক্ষা দেয়, তবুও জনগণের মাঝে ইসলামভীতি ছড়িয়ে গেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তারা মুসলিমদের কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। এ ছাড়া অনেক দেশ জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বা জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতা রক্ষায় বিশেষ আইন প্রয়োগ করে থাকে। অনেক দেশ আবার তাদের জাতীয় আইনে এই জাতীয় সুরক্ষাগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে।
যদিও বেআইনি অভিবাসন বা অত্যাধিক আইনি অভিবাসনের বিরোধিতা স্বাভাবিক বাকস্বাধীনতা এবং বৈধ রাজনৈতিক বক্তৃতার মধ্যে পড়ে। এসব দেশ অবৈধ অভিবাসী সংকট দূর করতে নানা আইন প্রয়োগের পরেও নিজেদের স্থানীয় সমস্যাগুলোর সঙ্গে তারা মুসলিমদের এক করে ফেলছে। এসব দেশে অভিবাসী অথবা মুসলিমরা সাধারণ অপরাধ করলেও তা গুরুতরভাবে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া কুরআন অবমাননা বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষকে আঘাত করেছে। তা সত্ত্বেও এসব দেশ নিজেদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে অটল রয়েছে। তারা তাদের স্থানীয় সমস্যার সঙ্গে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করে বক্তব্য দিচ্ছে। সুইডেনের ক্ষেত্রে, এটি দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত বিদ্বেষ জাগিয়েছে এবং এর খ্যাতি ও বৈদেশিক নীতির অনুশীলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে সুইডেনের সঙ্গে ন্যাটোর সম্পর্ক ভালো পর্যায়ে নেই। এর মধ্যেই কুরআন পোড়ানোর ঘটনা যেন আগুনে ঘি ঢেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন ওঠে, তবে কী এ ঘটনায় ইউরোপের অন্যান্য দেশের প্রভাব রয়েছে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য দেশের ইসলামভীতি সাংকেতিকভাবে সুইডেনে ফুটে উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের দেশে দেশে ইসলামভীতি আবার জেগে উঠছে। মত প্রতাশের স্বাধীনতার নামে পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে কটাক্ষ করছে।
মুসলিম দেশ এবং অন্যান্যরা এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মুসলিম সরকারগুলো বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে, সুইডিশ কর্তৃপক্ষ এটি ঘটতে দিয়েছে এবং জোর দিয়ে বলেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা উচিত। এ ঘটনার পর থেকে বিশ্বব্যাপী শত শত বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পেগিদা নামে পরিচিত ‘ইউরোপিয়ানস অ্যাগেইনস্ট দ্য ইসলামাইজেশন অফ দ্য অক্সিডেন্টের’ মতো বিদ্বেষী গোষ্ঠী একই ধরনের কাজ করেছে এবং গত ২৪ জানুয়ারি আমস্টারডামে কোরআনের একটি কপি পোড়ানোসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। যেহেতু পেগিডা ২০১৪ সালে জার্মানির ড্রেসডেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এর চরমপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি মূলধারার রাজনৈতিক বক্তৃতায় প্রবেশ করেছে এবং সুইডেনসহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে উগ্র ডানপন্থিরা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিচিতি লাভ করেছে।
পেগিদা এবং অনুরূপ গোষ্ঠীগুলো বারবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছে। অভিবাসীদের, বিশেষ করে মুসলিমদের নিয়ে অযৌক্তিক ভয় জাগিয়েছে। মাঝে মাঝে তারা কুরআন পোড়ানোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামভীতির জন্য অপপ্রচার যেমন দায়ী, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের ডানপন্থিরাও দায়ী। তারা সহজেই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, যা কমাতে হলে সমাজের মেলবন্ধন জোরদারের বিকল্প নেই। পাশাপাশি বাড়াতে হবে মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সম্প্রীতি।