ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৯ মার্চ, ২০২৩ ১২:১২ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৬৪ বার
ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আয়ের একটা অংশ সঞ্চয় করবেন। কিন্তু কোথায় রাখবেন টাকা। কেমন মিলবে সুদ বা মুনাফা। জমানো অর্থের নিরাপত্তা কতটুকু; এ নিয়ে অনেকেই চিন্তায় আছেন। তবে সহজলভ্য ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ব্যাংকে টাকা জমানোই ভরসা মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু সব ব্যাংক সমান সুবিধা দেয় না। এক্ষেত্রে কষ্টার্জিত অর্থ কোন ব্যাংকে রাখলে একটু বেশি মুনাফা মিলবে তার খোঁজে থাকেন সঞ্চয়কারীরা।
প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখাই মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প বা ডিপিএস (ডিপোজিট পেনশন স্কিম)। ডিপিএস নামে বহুল প্রচলিত হলেও বিভিন্ন ব্যাংকে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। এই হিসাবে একজন গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থ জমা করে থাকেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডিপিএসের বিপরীতে মাসিক, ত্রৈমাসিক, ছয় মাসিক ও বাৎসরিক সুদ দিয়ে থাকে।
সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয় করার সুযোগ রয়েছে। এসব সঞ্চয়ের বিপরীতে যে সুদ দেয়, তার নাম ফিক্সড ডিপোজিট রেট বা স্থায়ী আমানতে সুদের হার (এফডিআর)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৬০টি ব্যাংকের আমানতের সুদ বা মুনাফার তথ্য প্রকাশ করেছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবগুলো ব্যাংকের সুদহার এক রকম নয়। বিভিন্ন মেয়াদে সর্বনিম্ন ২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত এফডিআরে সুদ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশও সুদ অফার করছে কয়েকটি ব্যাংক।
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের মোট ৯টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এফডিআরে বিভিন্ন মেয়াদে সাড়ে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করছে। সাধারণ ডিপোজিটে ২ দশমিক ৬০ থেকে ৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই একই রেটে আমানতকারীদের সুদ দিচ্ছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক তিন মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময়ের ডিপোজিটের জন্য ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এছাড়া সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল ৫ দশমিক ৫০ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত আমানতকারীদের সুদ দিচ্ছি।
বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, পিকেবি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) বিভিন্ন মেয়াদের ডিপোজিটের জন্য ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।
বেসরকারি ব্যাংক
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সাধারণ সঞ্চয়ে ২ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। আর মেয়াদি আমানতে দিচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ। তবে কিছু ব্যাংক মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংকগুলো (মিডল্যান্ড, মেঘনা, পদ্মা ব্যাংক, ইউনিয়ন, মধুমতি, এসবিএসি প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল)।
দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বেশি সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন থেকে ছয় মাস কম সময়ের সুদ ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, ছয় মাস থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য ৭ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং এক বছর থেকে তার বেশি সময়ের জন্য আমানতের সুদ দিচ্ছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ। তিন মাস থেকে তিন বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য সাউথবাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসএবিসি) সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। প্রথম প্রজন্মের আইএফআইসি ব্যাংক সব ধরনের মেয়াদি আমানতে ৭ শতাংশ সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে।
মেয়াদি আমানতে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে এবি ব্যাংক, বেঙ্গল ব্যাংক, ব্র্যাক, এনসিসি এবং ওয়ান ব্যাংক। এছাড়া মেয়াদি আমানতে ৫ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইসিবি, মার্কেন্টাইল, প্রিমিয়ার, প্রাইম উত্তরা ও ন্যাশনালসহ বেশ কিছু ব্যাংক।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক
দেশের শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, শাহজালাল, এক্সিম, ইউনিয়ন, আইসিবি ইসলামিক, এনআরবি গ্লোবাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকগুলো সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা দিচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. বিভিন্ন মেযাদি সঞ্চয়ের ওপর মুনাফা দিচ্ছে ৬ দশমিক ৭৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর সবচেয়ে বেশি মুনাফা দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক। মেয়াদি আমানতে ব্যাংকটি ৭ দশমিক ২৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা দিচ্ছে।
বিদেশি ব্যাংক
বিদেশি ব্যাংকগুলো সাধারণত আমানত কম সংগ্রহ করে, তাদের সুদহারও কম। এ খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক মেয়াদি আমানতে ১ শতাংশ বা তার নিচে সুদ দিচ্ছে। তবে মেয়াদি আমানতে বিদেশি ব্যাংকগুলো ২ থেকে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।
বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে মেয়াদি আমানতে সবচেয়ে বেশি ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন। আর সবচেয়ে কম সুদ দিচ্ছে সিটি এনএ। ব্যাংকটির আমানতের সুদহার এক শতাংশের নিচে।
এছাড়া এফডিআরে আল-ফালাহ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, ওরি ব্যাংকের সুদের হার দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
মহামারিতে বিনিয়োগ-খরায় দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয়েছিল অলস তারল্যের পাহাড়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনিম্নে নিয়ে যায়। মহামারির আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ৬-৯ শতাংশ সুদ দিত, তারাই সুদহার নামিয়ে আনে দেড়-দুই শতাংশে। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও নানা অনিয়মের সংবাদে গ্রাহকরা আমানত তুলে নেওয়ায় বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। এছাড়া ঋণ বিতরণের পরিমাণও বেড়েছে। এসব কারণে বাড়তি অর্থের জোগান দিতে ব্যাংকগুলো আমানত টানতে সুদ বা মুনাফার হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে ব্যাংকগুলো এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ আমানতের সুদ দিচ্ছে তাতে ব্যাংকে টাকা রেখে পোষাচ্ছে না আমানতকারীদের। কারণ ব্যাংকগুলোর গড় সুদের হারের চেয়ে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার বেশি।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে। যা গড় আমানতের সুদ হারের দ্বিগুণ। জানুয়ারিতে গড় আমানতের সুদ ছিল ৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
এর আগে সর্বনিম্ন সুদহারও বেঁধে দিয়ে ২০২১ সালের ৮ আগস্ট একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকের তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ হার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। দেশের ভোক্তা মূল্যসূচকের হিসাবে গড় মূল্যস্ফীতির সাড়ে ৮ শতাংশের ওপরে। এ হিসাবে এখন ব্যাংকের সর্বনিম্ন সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশের ওপরে থাকার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, তাদের এ নির্দেশনা বেশিরভাগ ব্যাংক যথাযথ পরিপালন করছে না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এখন সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছে। যারা ব্যাংকে আমানত রেখে ওই মুনাফা দিয়ে জীবনযাত্রায় ব্যয় করেন তারা এখন শুধু মুনাফা নয়, আসলও ভেঙে খাচ্ছেন। কারণ মূল্যস্ফীতির তুলনায় সুদ বা মুনাফার হার অর্ধেকের চেয়েও কম। এমন পরিস্থিতিতে আমানতের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যাংকের সুদহার কোনো অবস্থায় কম হওয়া ঠিক নয়। এখন ব্যাংকগুলোতে সুদহার কম; এর মানে আমানতকারীদের সঞ্চয়ের রিটার্ন নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে। যা অর্থনীতির জন্য ভালো না। এতে অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই যেকোনো মূল্যে আমানতে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের ওপরে রাখতে হবে।
সাবেক এ গভর্নর বলেন, ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য মানুষ সঞ্চয় করে। এমন জায়গায় টাকা রাখা যাবে না যেখানে প্রয়োজনের সময় জমানো অর্থ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। সেজন্য শুধু বেশি মুনাফা বা সুদের দিকে না তাকিয়ে ব্যাংকের সক্ষমতা, আর্থিক অবস্থা ভালো, গুড গর্ভন্যান্স আছে এমন প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় করতে হবে বলে আমানতকারীদের পরামর্শ দেন ড. সালেহউদ্দিন।