ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৯ মার্চ, ২০২৩ ১৭:৪৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৯৯ বার
খুলনায় বাচ্চা ও খাবারের দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদন কমায় বাজারে হু হু করে বাড়ছে ব্রয়লার মুরগির দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ।
খাবারের দামসহ বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলে খামারিরা চরম লোকসানের মুখে পড়বেন। এজন্য পোলট্রি ফিডের দামসহ বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবি খামারিদের। এছাড়া পোলট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও ন্যায্য দাম না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় ইতোমধ্যে অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
খুলনার হরিণটানা মেইন রোড গলির জব্বার স্টোরের মালিক ইমন হোসেন মোস্তফা। তার দোকানে ছোট ছোট পলিথিনে মোড়ানো রয়েছে মুরগির মাংস। ওজন ভেদে কেটে রাখা এই মাংসের দাম ৫০, ১০০ ও ১৫০ টাকা। কেটে রাখা এই মুরগির মাংস কিনতে ভিড় করছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। প্রয়োজন অনুযায়ী মুরগির মাংস কিনছেন তারা। স্বল্প আয়ের মানুষের সুবিধার জন্য এভাবে মুরগি কেটে বিক্রি করছেন বলে জানান ইমন হোসেন মোস্তফা।
তিনি বলেন, মুরগি কেটে ওজন দেওয়ার পর তার কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা হয়। সেখান থেকে যদি কেউ ৫০ টাকার মাংস চায়, তাকে তা দেওয়া হয়। সাধ্য অনুযায়ী যে যতটুকু চায় আমি ততটুকুই দিই।
তিন থেকে চার মাস হলো মুরগি কেটে বিক্রি করা শুরু করেছি। আমি একদিন মুরগি কিনতে গিয়েছিলাম। একটি মুরগি মাপার পর ৫০০ টাকা দাম হয়েছিল। তখন চিন্তা করলাম দুইজন মানুষ একটি মুরগি ৫০০ টাকা দিয়ে কিনব? তখন থেকে মুরগি কেটে বিক্রি করার পরিকল্পনা আসে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ খুব খুশি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, তিন থেকে চার মাস হলো মুরগি কেটে বিক্রি করা শুরু করেছি। আমি একদিন মুরগি কিনতে গিয়েছিলাম। একটি মুরগি মাপার পর ৫০০ টাকা দাম হয়েছিল। তখন চিন্তা করলাম দুইজন মানুষ একটি মুরগি ৫০০ টাকা দিয়ে কিনব? তখন থেকে মুরগি কেটে বিক্রি করার পরিকল্পনা আসে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ খুব খুশি হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ এখানে এসে মুরগি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি।
ইমন হোসেনের দোকানে মাংস কিনতে আসা তানিয়া খাতুন বলেন, একটি মুরগি কিনতে গেলে অন্তত ৫০০ টাকা প্রয়োজন। ফলে সবসময় কেনা হয় না। কিন্তু মাংস কেটে বিক্রি করলে সাধ্যমতো কিনতে পারি। এটা আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। এছাড়া তারও বিক্রি অনেক বেড়েছে।
আবুল হাসেম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, আমার পক্ষে মাসে একটি মুরগি কেনা সম্ভব নয়। এখান থেকে আমি সপ্তাহে ৫০, ১০০ ও ১৫০ টাকার মাংস কিনে খেতে পারছি। এটি আমাদের জন্য সুবিধা।
হরিণটানা মেইন রোডের বাসিন্দা মনিরা বেগম বলেন, এখন মুরগির যে দাম, একটি মুরগি কিনতে গেলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা প্রয়োজন। এই দোকানে মুরগি কেটে বিক্রি করছে। এতে আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়েছে।
খুলনার বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের মুরগির দাম কেজিতে ৬০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে । আগে যে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। লেয়ার মুরগি আগে বিক্রি হয়েছে ২৩০ টাকা কেজিতে, এখন ২৯০ টাকা। আর সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটে আসা মুরগির ক্রেতা মো. ফারুক হোসেন বলেন, মুরগির দাম গরিবের নাগালের বাইরে। কিনতে গেলে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
খালিশপুর প্লাটিনাম গেট এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, মুরগির দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি ছিল। তখন কিনতে পারতাম। এখন ২৪০ টাকা হয়েছে, যা আমাদের নাগালের বাইরে। শুক্রবারে গরুর গোশত কেনা দূরের কথা মুরগি কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে মুরগির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও কমেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটের মুরগি বিক্রেতা মো. লিটন হোসেন বলেন, বেচাকেনা অনেক খারাপ। আগের চেয়ে অর্ধেকেরও বেশি বিক্রি কমে গেছে। কি আর করার, সবকিছুর দাম বেশি। মানুষ মুরগি কিনবে না অন্য বাজার করবে!
মুরগি বিক্রেতা শের-এ-আলম বলেন, একটি মুরগি ২২৫ টাকায় পাইকারি কিনে ড্রেসিং করে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করি। এতে আমাদের পাঁচ টাকার মতো লাভ হয়। কিন্তু এখন কাস্টমার তেমন নেই বললেই চলে।
বটিয়াঘাটা গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের খলিশাবুনিয়া গ্রামের খামারি বিশ্বজিৎ তরফদার বলেন, আমার একটি এক হাজার মুরগির শেডের খামার ছিল। আমি প্রায় চার বছর পালন করার পর ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি। খাবারের দাম বাড়তি কিন্তু সেই তুলনায় ডিমের দাম কম। সমিতি থেকে লোন নিয়ে সেই লোন পরিশোধ করতে পারিনি। ধীরে ধীরে আমার খামারটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমি ডিম সংগ্রহ করে বিক্রি করি।
দিঘলিয়া সরদারপাড়া গ্রামের খামারি ইলিয়াস সর্দার বলেন, বিদেশ থেকে এসে দুই বছর হলো পোলট্রির ব্যবসা করছি। আগে এ ব্যবসা ভালেই ছিল কিন্তু এখন খারাপ অবস্থা। এখন মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম অনেক বেশি। কিন্তু মুরগি বিক্রি করতে গেলে দাম কম। অর্ধেকের বেশি লোক খামার বন্ধ করে বসে আছেন।
নগরীর লবণচরা রিয়া বাজারের পোলট্রি খাবার বিক্রেতা মনির মোল্লা বলেন, পোলট্রির খাবারের দাম বেড়েছে। দুই দফায় এক বস্তা খাবারের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। আগে এক বস্তা খাবারের দাম ছিল ৩ হাজার টাকা, বর্তমানে সেই খাবারের দাম ৩ হাজার ২০০ টাকা। যেমন দামে কিনেছি, তেমনি বিক্রি করছি।
খুলনা পোলট্রি ফিশ ফিড শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এসএম সোহরাব হোসেন বলেন, আগে যেখানে একটি মুরগির বাচ্চা ৮ থেকে ১০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেই বাচ্চার দাম ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এছাড়া মুরগির খাবারের দাম আগে ছিল প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এখন সেই খাবারের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। মুরগি উৎপাদনে যে টাকা ব্যয় হচ্ছে, সেই টাকা উঠছে না। ফলে অনেকে ধারদেনা করে এখন ব্যবসা গুটিয়ে পথে বসেছে। অনেকে ধারদেনার দায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের নামে মামলা হচ্ছে। খামারিরা খুব দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে প্রাণিসম্পদের কর্মকর্তারা যদি কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে খামারিরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অরুণ কান্তি মন্ডল বলেন, বর্তমানে পোলট্রি খাবারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মুরগির খাবারের জন্য ভুট্টার প্রয়োজন। এই ভুট্টা আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ১৮ টাকার ভুট্টা এখন বেড়ে ৩৮ থেকে ৪২ টাকা হয়েছে।
এছাড়া সয়াবিনের খৈলও আমদানি করা হয়। ১০০ কেজির মধ্যে ৭৫ কেজি ভুট্টা ও সয়াবিনের খৈল দিয়ে খাবার তৈরি হয়। এসবের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। প্রতিটি খাবারের মূল্য বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এখন লেয়ার মুরগির এক কেজি খাবারের দাম ৭২ থেকে ৭৫ টাকা। সঙ্গত কারণে খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে ডিম ও মুরগির মাংসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে যখন খাবার ও বাচ্চার দাম কমতে থাকবে, তখন মুরগি ও ডিমের দামও কমতে থাকবে।
খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, খুলনায় কিছু খামার বন্ধ হয়েছে এটা সত্য। আবার নতুন করে দু-একটা হয়নি তাও নয়। অনেকে বলছেন এই মুহূর্তে বাচ্চার দাম বেশি, এজন্য খামারে বাচ্চা উঠাচ্ছেন না। সময়-সুযোগ বুঝে তারা বাচ্চা উঠাবেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মতে, খুলনায় ২ হাজার ৪৯২টি পোলট্রি খামার রয়েছে। তবে মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলার প্রান্তিক পর্যায়ে ৪ হাজার ৯৫২টি পোলট্রি খামার রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১ হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে।