ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২০ মার্চ, ২০২৩ ১২:৫৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪০২ বার
আইন লঙ্ঘন করে বিমা গ্রাহকের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসেছে নতুন প্রজন্মের বিমা কোম্পানি আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। তবে প্রতি বছর কোম্পানিটি যে নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করছে, তার সিংহভাগ তামাদি হয়ে যাচ্ছে। এতে অবৈধ ব্যয় বন্ধ হলেও মজবুত হয়নি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা। ফলে ভবিষ্যতে গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে থেকে যাচ্ছে শঙ্কা। একই সঙ্গে কোম্পানিটির টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
জীবন বিমা কোম্পানিটির আর্থিক চিত্র তদন্ত করে এমন তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই তদন্ত করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ‘মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও প্রশাসনিক ব্যয় এবং অন্যান্য অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ভবিষ্যতে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে’ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ জুলাই ১৩টি বিমা কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা তদন্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সম্প্রতি আলফা ইসলামী লাইফের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল। তদন্তে আলফা লাইফের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়া, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়ে বিমা ব্যবসার নিবন্ধনের শর্ত লঙ্ঘনসহ বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, একটি সময় আলফা লাইফ গ্রাহকদের টাকা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি তিন বছরে ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ৬ কোটি ২৮ টাকা। তবে ২০২০ এবং ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যয় আইনি সীমার মধ্যেই ছিল।
একটি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ করতে পারবে তা আইন দিয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে আলফা লাইফের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ, আইন লঙ্ঘন করে এ খাতে অবৈধভাবে খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
পরের বছর ২০১৮ সালে এ খাতের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়। ২০১৯ সালে আইন লঙ্ঘন করে খরচ করা হয় ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী বছরটি ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত হয় ২ কোটি ৮ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
আইডিআরএ’র তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, প্রতিবছর কোম্পানিটির সিংহভাগ পলিসি তামাদি বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটি নতুন পলিসি ইস্যু করে প্রিমিয়াম আয় করে ৩৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এছাড়া নতুন পলিসি বিক্রি করে ২০২০ সালে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৩৬ লাখ, ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৪৬ লাখ এবং ২০১৭ সালে ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করে।
২০১৮ সালে দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয় মাত্র ৬৩ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৯ তা কমে মাত্র ৩০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ২০২০ দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয় ৪৯ লাখ টাকা। আর ২০২১ সালে হয়েছে ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার ২০১৮ সালে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০২০ সালে ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অর্থাৎ, কোম্পানিটি প্রতি বছর নতুন যে পলিসি বিক্রি করছে পরের বছরেই তার সিংহভাগ আর নবায়নে আদায় হচ্ছে না।
কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ে করুণ দশা বিরাজ করলেও ২০২১ সালে লাইফ ফান্ডে বড় ধনের উত্থান হয়েছে। ২০২০ সালে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১ কোটি ২ লাখ টাকা। ২০২১ সালে তা এক লাফে বেড়ে ১৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা হয়। এছাড়া ২০১৭ সালে ৭৩ লাখ, ২০১৮ সালে ১ কোটি ১৮ লাখ এবং ২০১৯ সালে ৫৪ লাখ টাকা লাইফ ফান্ড ছিল কোম্পানিটির।
প্রতিষ্ঠানটির লাইফ ফান্ডের এ চিত্র সম্পর্কে একটি জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আলফা লাইফের লাইফ ফান্ডে এক ধরনের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। কিন্তু ২০২১ সালে এক লাফে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড যেভাবে বেড়েছে তা সন্দেহজনক। তাছাড়া কোম্পানিটির দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের হার ভালো না। সুতরাং, কোম্পানিটি কাগজে ব্যবসা দেখিয়ে লাইফ ফান্ড বাড়িয়ে দেখাচ্ছে কি না এবং কোম্পানি থেকে কমিশন বাবদ অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।
কোম্পানিটির ইস্যু করা পলিসি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও। আলফা লাইফের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করে আইডিআরএ’র তদন্ত দল অভিমত দিয়েছে, দ্বিতীয় বর্ষ প্রিমিয়াম নবায়ন হার (গড়ে প্রতি বছর ১৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ) খুবই কম। অর্থাৎ, কোম্পানির ইস্যু করা পলিসিগুলো কাগজে ব্যবসা বা টার্গেট পূরণের জন্যই হয়ে থাকতে পারে। ফলে আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে টিকে থাকা কোম্পানিটির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে।
তদন্ত দল আরও অভিমত দিয়েছে, কোম্পানির বর্তমান গ্রস প্রিমিয়াম বৃদ্ধির হার (১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ), সম্পদ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার (গড়ে প্রতি বছর ২৬ দশমিক ৯০ শতাংশ ও ১২ দশমিক ১০ শতাংশ) সন্তোষজনক হলেও কোম্পানির আর্থিকভিত্তিকে মজবুত করতে পারেনি। কোম্পানি ভবিষ্যতে গ্রাহকের দায় পরিশোধে সফল নাও হতে পারে।
তদন্তকারী দল কোম্পানিটির দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন ৬০ শতাংশের ওপরে আনতে হবে বলে অভিমত দিয়েছে। একই সঙ্গে কমিশন ব্যয়সহ অন্য প্রশাসনিক ব্যয় কমানোর কথা বলেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়ে কোম্পানিটি অনুমোদন লাভের শর্ত ভঙ্গ করেছে বলেও অভিমত তদন্ত দলের। একই সঙ্গে বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে কোম্পানির প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে আলফা লাইফ সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করা নুরে আলম ছিদ্দিকী (অভি) জাগো নিউজকে বলেন, আইডিআরএ’র তদন্তদল এখনো তদন্ত শেষ করেনি। তারা এখনো তদন্ত করছে। এর মধ্যেই তারা কীভাবে তদন্ত প্রতিবেদেন তৈরি করলো? এ বিষয়ে জানতে চেয়ে আমরা আইডিআরএকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এখনো তারা আমাদের কিছু জানায়নি।
কোম্পানির আর্থিক চিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। আমরা ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে নিয়ে এসেছি। নবায়ন প্রিমিয়াম আয় বাড়ছে। তাছাড়া যেহেতু এখনো তদন্ত শেষ হয়নি, তাই এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে করা তদন্তে যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে আইডিআরএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, তদন্তে বেরিয়ে আসা অনিয়মের বিষয়ে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে এখনো সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তদন্তে বেরিয়ে আসা অনিয়মের তথ্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে কি? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তদন্তে প্রতিবেদন কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তখন সে সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হবে।