ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প মুদ্রায় ঝুঁকছে সরকার

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৮ মে, ২০২৩ ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৩০ বার


রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প মুদ্রায় ঝুঁকছে সরকার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এখন বিশ্বজুড়ে ডলারের দামে অস্থিরতা চলছে। বাংলাদেশে এর দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। পরিস্থিতি এমন, সেই বাড়তি দামেও পাওয়া যাচ্ছে না ডলার। ফলে এর জোগান দিতে গিয়ে চাপ পড়ছে রিজার্ভের ওপর। আবার ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে আমদানি প্রক্রিয়াও। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্বের অনেক দেশই স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনে যাচ্ছে। সেই পথে হাঁটছে বাংলাদেশও। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প মুদ্রায় ঝুঁকছে সরকার। এরই মধ্যে ডলারের বিপরীতে ভারতের রুপি ও চীনা ইউয়ান ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব উদ্যোগের ফলে এখনই রিজার্ভের চাপ কমানো সম্ভব নয়। চাপ কমাতে হলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করতে হবে। নির্ধারণ করতে হবে একক রেট।

তাদের মতে, বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো সুদূর ভবিষ্যতে কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে। চীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তিশালী অর্থনীতি। তাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও বেশ ভালো এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। সে ক্ষেত্রে চীনের মুদ্রার ওপর ভরসা করা যায়। ভারতও বড় এবং সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। তা ছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। তাই রুপিতেও বাণিজ্য হতে পারে।

ইউয়ান ও রুপি এখনো ডলারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে চীন ও ভারতের ওপর বাংলাদেশ আস্থা রাখতে পারে বন্ধু দেশ হিসেবে। তাই অদূর ভবিষ্যতে চীন ও ভারতে রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে রুপি এবং ইউয়ানের জোগান আরও বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। দেশগুলোকে এ সুযোগে চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে, যাতে তারা বাংলাদেশ থেকে আমদানি বৃদ্ধি করে। তবে এই মুহূর্তে সংকট নিরসনে এসব উদ্যোগ তেমন প্রভাব ফেলবে না।

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেসব মুদ্রা কেনার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কিনতেও ডলার লাগবে। তাহলে ডলার দিয়ে ইউয়ান বা রুপি কিনতে যাব কেন? এই মুহূর্তে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে হলে সেখান থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সুদহার বাড়াতে হবে।

স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার যে উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটা নিতে পারে। তবে এই মুহূর্তে এর কোনো প্রভাব রিজার্ভের ওপর পড়বে না। এটা সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো সুফল বয়ে আনতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে লেনদেন বাড়াতে হলে দুদেশের বাণিজ্যক্ষেত্রে যেসব অশুল্ক বাধা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে।

ডলারের ওপর চাপ কমাতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি অংশ নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেনে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। তৃতীয় কোনো মুদ্রার সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই সরাসরি টাকা ও রুপির মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির মূল্য বিনিময়ের উদ্যোগ নিচ্ছে এ দুদেশ। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য ভারতীয় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে লেনদেন হিসাব খুলবে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক। একইভাবে বাংলাদেশের এ দুটি ব্যাংকে হিসাব খুলবে ভারতীয় দুই ব্যাংক।

দুদেশের নিজস্ব মুদ্রার মধ্যে লেনদেন প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে সম্প্রতি ঢাকা এসেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিনিধি দল। তারা গত ১১ এপ্রিল বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকে (ইবিএল) বৈঠক করে। সেখানে ইবিএল ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সফরকারীরা টাকা এবং রুপিতে দুদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, টাকা-রুপিতে লেনদেনে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন এই বিষয়ে প্রক্রিয়াগত কাজ চলছে। সেটা শেষ হলেই লেনদেন শুরু হবে। পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে প্রাথমিকভাবে চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে এই লেনদেন চালু করা হবে। পরে এটি আরও বিস্তৃত হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি যত বাড়বে, রুপিতে বাণিজ্যের সম্ভাবনা ততই বাড়বে। বাংলাদেশে এখন ভারতে ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি করে। এর বেশি পণ্য রুপিতে কেনা যাবে না, কারণ রপ্তানি ছাড়া রুপি পাওয়ার সুযোগ নেই। সে জন্য অশুল্ক বাধা দূর করে ভারতে রপ্তানি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তারা।

অন্যদিকে ডলারের ওপর চাপ কমাতে অন্যান্য দেশের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে এলসি খোলার অনুমিত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ইউয়ানে পরিশোধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ তৈরির একটি প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। তাদের প্রস্তাবিত অন্য মুদ্রাগুলো হলো পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন ও রুবল।

এর আগে ডলারে নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া বাংলাদেশের কাছে ঋণের অর্থ চেয়েছিল রুবলে। তবে রুবলে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না জানিয়ে চীনা মুদ্রায় সম্মতি দেয় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এক নির্দেশনায় ইউএস ডলার, ইউরো, জাপানি ইয়েন, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড ও কানাডিয়ান ডলারের পাশাপাশি ইউয়ানে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে তখন ব্যাংকগুলো এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। এরপর গত বছর কয়েকটি ব্যাংক চীনা মুদ্রায় ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খোলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর অথরাইজড ডিলার শাখা চীনের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে ইউয়ান মুদ্রায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। যদিও ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা হাতে গোনা কয়েকটি এলসি খুলেছে ইউয়ানে।

চীন হচ্ছে বাংলাদেশের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৭ হাজার ৮২৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। দেশটি থেকে আমদানি করা হয় ১৮ হাজার ৫০৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। রপ্তানি করা হয় ৬৮৩ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময় ডলার ব্যবহার করে আসছে। তাই চাইলেই ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে কি না সেটি নিয়েও সংশয় রয়েছে। রপ্তানি কম হওয়ায় ইউয়ানের জোগান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। এ অবস্থায় বাণিজ্যের লেনদেন ও প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে চীনা মুদ্রা কতটা ব্যবহার করা যাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

বিশ্বের পাঁচ দেশের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ‘হাই ভ্যালু কারেন্সি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের ইউয়ান তাদের মধ্যে অন্যতম। আইএমএফের কারেন্সি বাস্কেটে ইউয়ান স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৬ সালে। এরপর থেকে সংস্থাটির পর্যালোচনায় মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তবে ভারতীয় রুপি এখনো আইএমএফের স্বীকৃতি পায়নি। ফলে টাকা-রুপিতে লেনদেনে এটিও একটি বড় বাধা তৈরি হতে পারে।

স্থানীয় মুদ্রায় বৈদেশিক লেনদেনে একটি বড় সমস্যা এর জোগান। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আসে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স থেকে। দুটিই আসে ডলারে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের, আর ভারত ও চীনের সঙ্গে ঘাটতি। ফলে ভারত ও চীনের সঙ্গে রুপি ও ইউয়ানে লেনদেন করতে গেলে বিপুল পরিমাণ রুপি এবং ইউয়ানের প্রয়োজন পড়বে, যা জোগার করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন।

এদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। ফলে একদিকে রিজার্ভের পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এই ঋণের শর্ত হিসেবে আগামী জুনে দেশের নেট রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার হতে হবে। যদিও এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


   আরও সংবাদ