ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

চাপ-দায় সঙ্গে নিয়ে আসছে বাজেট

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২৯ মে, ২০২৩ ০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩০৫ বার


চাপ-দায় সঙ্গে নিয়ে আসছে বাজেট

বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির ভয়াবহ চাপ এবং বিরাট বকেয়া ভর্তুকির বাড়তি ব্যয় মেটানোর দায় সঙ্গী করেই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে এই ব্যয় ১৫ দশমিক ২ শতাংশের সমান, যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেশি। ভোটের বছরে যতটা সম্ভব জনতুষ্টি পূরণ করে আগামী এক বছর সরকারি উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন দায় মেটাতে তিনি এই বিশাল ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যেই আগামী অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ৭ দশমিক ৫ অর্জন করতে চান অর্থমন্ত্রী। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। অন্যদিকে যে মুহূর্তে তিনি এই বাজেট উপস্থাপন করছেন, তখন দেশে চাহিদা ও জোগানের অসমতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মূল্যস্ফীতির সীমাহীন চাপে নাভিশ্বাস অবস্থা সাধারণ মানুষের। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বাদে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ। যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, সার, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেলের যে দাম, তার তুলনায় দেশের বাজারমূল্য অনেক বেশি। যখন সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটি, অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণের বিপরীতে মোটা অঙ্কের সুদ পরিশোধ এবং অভ্যন্তরীণ চোরাচালান ও মজুদদারির কারণে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি তৈরি হচ্ছে। গত (নভেম্বর ২০২২-এপ্রিল ২০২৩) ৬ মাসের সাধারণ মূল্যস্ফীতির গড় হার ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ দাঁড়িয়েছে, তখন আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর এই মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যখন মুদ্রানীতির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমানোর পথে সরকার, তখন অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের মোট বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরতে যাচ্ছেন জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

যদিও অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে এর সপক্ষে বলেছেন, অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান আকার এবং বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় কম আয়ে বেশি ব্যয়ের এই বাজেট বাস্তবায়ন করে সব লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব। আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী এই বাজেট প্রস্তাব করবেন। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দীর্ঘ কয়েক মাসের বিরামহীন কর্মঘণ্টা ব্যয় করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে নিজ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে অর্থমন্ত্রীর সম্মতিতে বাজেটে সরকারি ব্যয়ের এই আকার নির্ধারণ করেছেন।

সম্ভাব্য প্রস্তাবিত এই বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার লক্ষ্য ধরে অর্থমন্ত্রী তাতে সরকারি আয়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রস্তাব করবেন ৫ লাখ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ১০ শতাংশের সমান। তবে চলতি অর্থবছরের মূল্য লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বাজেটে মোট ঘাটতি নির্ধারণ করেছেন ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ২ শতাংশের সমান।

ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী অর্থ সংগ্রহের দুটি উৎস খাত চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে কোন উৎস থেকে কত টাকা তিনি ঋণ করবেন, সেটিও স্পষ্ট করেছেন। বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী জানা গেছে, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস্য থেকে অর্থমন্ত্রী মোট ১ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন। এটা মোট ঘাটতি অর্থায়নের ৫৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এ পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে তিনি ঋণ নিতে চান ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে নেবেন ২৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা নেবেন বিদেশি ঋণ।

এদিকে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার ব্যয়ের বাজেট থেকে অর্থমন্ত্রী খরচের দুটি খাত নির্ধারণ করেছেন। এর একটি হলো সরকারের আবর্তক ব্যয় বা পরিচালন ব্যয়। এর আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, যা মোট সরকারি ব্যয়ের ৬৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং জিডিপির ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যটি হলো উন্নয়ন ব্যয়, যার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছর উন্নয়ন ব্যয়ের মোট আকারকেও দুইভাবে নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ব্যয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ এডিপির জন্য।

এদিকে মোট আয়ের লক্ষ্য যে ৫ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে—এই আয় সংগ্রহে অর্থমন্ত্রী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দায়িত্ব দিয়েছেন ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটা জিডিপির ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। বাকি আয় তিনি সংগ্রহ করবেন নন-এনবিআর কর খাত থেকে ২০ হাজার কোটি এবং করবহির্ভূত খাত (এনটিআর) থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রী পরিচালন ব্যয়ের যে আকার নির্ধারণ করেছেন, সেখান থেকে বিভিন্ন সরকারের সময় নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন বাজেটের ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ বা ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। সুদ পরিশোধ খাতগুলোর মধ্যে সরকারের যে অভ্যন্তরীণ ঋণের য়েছে, তার সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৮২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করবেন বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের খাতগুলোর মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাতে ব্যয় হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি বিল-বন্ডের সুদে যাবে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের জিপিএফ খাতের সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৮ হাজার কোটি টাকা।

এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় নির্ধারণ করা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ রাখা হয় ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।

এদিকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে সরকার ব্যয় করবে মোট ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই ভর্তুকির বড় অংশ ব্যয় করা হবে বিদ্যুতে, যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষিতে যাবে ১৭ হাজার কোটি, রপ্তানি ভর্তুকিতে যাবে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা এবং প্রণোদনায় ব্যয় হবে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভর্তুকিতে ব্যয় হবে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা।

অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরও সরকারের ব্যয়ের বড় অংশ যাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির খাতগুলোর ব্যয়ে। আগামী অর্থবছর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এটা মোট বাজেট ব্যয়ের ১৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ। একইভাবে জিডিপির ২ দশমিক ৫২ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নিজের অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, সরকার বাজেটের যে আকার নির্ধারণ করেছে বা করতে যাচ্ছে, বাস্তবতার নিরিখে সেটি খুব বড় নয়। তবে বাজেটের আকার যেটাই নির্ধারণ করুক না কেন, সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। একইভাবে ঘাটতি অর্থায়নের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, তার বড় অংশ নেবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি সবারই জানা। তারল্যে সংকটে অনেক ব্যাংক। এ অবস্থায় সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পেতে হলে টাকা ছাপানোর কোনো বিকল্প থাকবে না। সেটি করতে গেলে বাজারে ফের মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হবে এবং মূল্যস্ফীতি আরও উসকে যাবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের যে জিডিপি ও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, আমরা চাই সরকার সেটি অর্জনে সক্ষম হোক। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এটা সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনী বছরে একদিকে যেমন প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে, অন্যদিকে দেশের ইতিহাসে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও এখন পর্যন্ত জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিনিয়োগ টানা সম্ভব হয়নি। এর বড় উৎস বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সাধারণত ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যা বাজেটে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ লক্ষ্য ধরা হয়েছে। যা অসময়ে একরকম অসম্ভবই বটে।


   আরও সংবাদ