ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

অসময়ে অস্বাভাবিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৩১ মে, ২০২৩ ১০:০৫ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৩১ বার


অসময়ে অস্বাভাবিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা

করোনা-পরবর্তী বহুমুখী পুনরুদ্ধার চেষ্টায় দেশের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির কিছুটা গতিশীলতার আভাস পাওয়া গেলেও সেটি বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারেনি। উদ্বেগের খবর হলো, স্থানীয় বিনিয়োগ বস্তুত স্থবির, বিনিয়োগের পরিবেশ-পরিস্থিতির অবস্থাও তথৈবচ। তদুপরি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছে সবকিছু। বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাব ও ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটি এখন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দৃশ্যমান বাস্তবতা। ক্রেতা-ভোক্তা তথা ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরাও অনেকটা আস্থাহীনতার সংকটে। এ রকম নানা অসংগতির ওপর দাঁড়িয়ে দেশ থেকে পুঁজি ও মেধা বা উদ্যোক্তা বিদেশে পাচার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণের মধ্যে শঙ্কা ও সংশয় স্পষ্ট হতে যাচ্ছে।

অর্থাৎ একটা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অভিমুখে হাঁটছে দেশ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতির নাজুকদশা। এ অবস্থায় যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুঁজি প্রত্যাহারের চিন্তায় রয়েছেন—সেখানে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বহুল প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হঠাৎ বেড়ে যাবে, এমন আশা করাও সমীচীন নয়। ঠিক এরকম বড় অসময়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য প্রস্তাবিত বাজেটে অস্বাভাবিক বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঢালি সাজিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যেখানে তিনি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিনিয়োগ আনার প্রস্তাব করবেন বলে মনস্থির করেছেন, টাকার অঙ্কে চলতি মূল্যে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৯২ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ অর্থবছর জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রীর এই বিরাট বিনিয়োগ পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতের অংশীদারত্ব রাখার প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার সমান। বাকি বিনিয়োগ তিনি সরবরাহ দিতে চান সরকারি খাতের মাধ্যমে। আগামী অর্থবছর সরকারি বিনিয়োগ প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন জিডিপির ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এটি মোট ৩ লাখ ২০ হাজার কোটির সমান।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর এই বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ লক্ষ্য অর্জনের হালনাগাদ তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশ না করলেও দেশে অর্থবছরজুড়ে যে অস্থিরতা ও বিনিয়োগ খরা চলছে, তাতে এই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যাওয়ার দাবিও বাস্তবতাবিবর্জিত হবে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, বিনিয়োগ টানতে সরকার যে পরিকল্পনার কথা বলছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার অনেক ফারাক। যদিও আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগের এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন করবেন অর্থমন্ত্রী, বাজেট বক্তব্যে তার খানিকটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টাও রাখবেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর   নিজের অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, সরকার বাজেটে যে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে বলে শোনা যাচ্ছে, কোনো একটি অর্থবছরে স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক-শান্ত পরিস্থিতিতেও দেশের ইতিহাসে কোনোদিন এত বড় বিনিয়োগ হয়নি। তার মানে যে হবে না, বিষয়টি এমনও নয়। জিডিপির আকার অনুযায়ী যে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, আমরা চাই সরকার সেটি অর্জনে সক্ষম হোক। তবে সে সময়টি নানা প্রাসঙ্গিক কারণেই আগামী অর্থবছর নয়। বাস্তবতা বলছে, এটা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, একদিকে বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, তার বড় অংশ নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি সবারই জানা। তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক। এ অবস্থায় সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পেতে হলে বেসরকারি খাতে ঋণ ছাড় কমাতে হবে। তা ছাড়া জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিনিয়োগ টানার বড় উৎস্য হলো বেসরকারি খাত। যেখানে বিনিয়োগ সাধারণত ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এটি আগামী বাজেটে যে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ হবে বলে জেনেছি, দেশের অসময়ে একরকম লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভবই বটে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআিই) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু   বলেন, সরকার যে লক্ষ্যে নিয়ে এগোচ্ছে, তার ভিশন-মিশন বাস্তবায়নে নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট কিছু রূপরেখা থাকবে। তবে এটা ঠিক, মোটা দাগে যে কোনো দেশে বিনিয়োগ লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। সেটি অনুকূলে থাকলে জাতীয় বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার বা সেখানে বেসরকারি খাতের অংশীদারত্বকে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি হলেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকলে সেটি সম্ভব না-ও হতে পারে। কতটা হবে, সেটি সময়ই বলে দেবে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই এসেছে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। জুন ২০২২ সালের হিসাবে দেশে বর্তমানে মোট এফডিআই রয়েছে ২ হাজার ৫০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় এই এফডিআই প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে।

তবে বিনিয়োগ সম্ভাবনা ক্ষেত্রও বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। এখনই প্রায় ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতির দ্বারপ্রান্তে। তা ছাড়া ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪১তম অবস্থানে রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী: ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৬তম, ২০২৮ সালের মধ্যে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে ২৪তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। জনগণের ভোগ প্রবণতা বাড়ছে। ক্রয়ক্ষমতারও উন্নতি হচ্ছে। এগুলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক বলে মনে করে সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এগারোটি খাতকে নির্বাচিত করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও আর্থিক সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাটবস্ত্র এবং সমুদ্র অর্থনীতি। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বিনিয়োগ বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি নিরাপদ উদাহরণ। আর প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ১১টি খাতে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্যদিকে দেশে এখন একযোগে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞ চলছে। এসব অঞ্চলের অনেকগুলো এখনই বিনিয়োগের হাব হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এসব অঞ্চলে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৭৫ কোটি ডলার বা ২৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা বলছে।


   আরও সংবাদ