ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২ জুন, ২০২৩ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৭২ বার
জনপ্রতিশ্রুতি পূরণ, মানুষকে স্বস্তিতে রাখা ও সংকটে থাকা অর্থনীতিকে ফের গতিশীল করে আগামীতে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরে সরকারের হরেক স্বপ্নের কথা আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তুলে ধরলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে এ বাজেটের বিভিন্ন পদক্ষেপে দাতা সংস্থার শর্তপূরণের নমুনা দেখা গেছে। এ শর্তে ঘেরা পথচলায় এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রী সরকারের আয় বাড়ানোর নানা কৌশল প্রয়োগের পরিকল্পনাও পরিষ্কার করেছেন।
অন্যদিকে ব্যয় কমাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের ভর্তুকি পুরোপুরি পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়ার এবং বিভিন্ন আর্থিক খাতে সংস্কারের ওপর জোর স্পষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি, মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা সহজ করতে সরকারের
জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার প্রতিফলনও দেখা গেছে। অর্থমন্ত্রী বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নসহ সরকারের নতুন ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে সঠিক পথে চলতে সহায়তা করবে।
এভাবে হরেক স্বপ্নে ভরা, শর্তে ঘেরা বাজেটের অভীষ্ট লক্ষ্যগুলো অর্জনে আগামী অর্থবছর মোট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা সরকার খরচ করবে বলে ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে তার বাজেট বক্তব্যে এ পরিমাণ ব্যয়ের অভিপ্রায় তুলে ধরেন তিনি। যেখানে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যে বাজেটের মূল স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে—‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, আগাম প্রস্তুতি ও সুনির্দিষ্ট বরাদ্দেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ২ শতাংশের সমান। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ আর রাজস্ব আয় ৫ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।
এর আগে সকালে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদনের জন্য সংসদ সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উভয় অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন পাওয়ার পর তা সংসদে পেশ করার সম্মতি দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর এ উদ্দেশ্যে বিকেল ৩টায় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার মেয়াদে পঞ্চম, দেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৫তম বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিনের এটাই প্রথম বাজেট অধিবেশনে যোগদান।
এদিকে যে মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী এই বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তখন দেশে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে ভীষণ চাপে আছে সাধারণ মানুষ। প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য, যতটা সম্ভব এ চাপ কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ফেরানোর। অর্থনীতিও বেশ ঝুঁকিতে; তাকে ফের স্থিতিশীলতায় ফেরানোর। আবার যে ব্যয়ের বাজেট তিনি দিয়েছেন, সেখানে ঘাটতি বিরাট। তাই ব্যয় অনুযায়ী আয় করার সিদ্ধান্তও রেখেছেন। এজন্য তিনি দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঘাটতি পূরণে ঋণ নেবেন বলে জানিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে সহনীয় মূল্যস্ফীতি রাখার লক্ষ্য যাতে বিচ্যুত না হয়, তার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা ও কয়েকটি খাতে ভাতার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। আগামী জানুয়ারিতেই দেশে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন ঘিরে খানিকটা ভোটার তোষণ পদক্ষেপও রাখা হয়। সব মিলিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে একটি বহুমুখী চাপ উতরে ওঠার রূপরেখা রয়েছে। তবে এই বহুমুখী চাপ সামলে বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্য ও কর্মকৌশল কীভাবে অর্জন ও বাস্তবায়ন করবেন—এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
চার বছর আগে অর্থমন্ত্রী যখন তার প্রথম বাজেট উত্থাপন করেন, তখন অর্থনীতি ছিল শক্তিশালী, মূল্যস্ফীতিও ছিল নিম্ন। বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকই ছিল প্রথম বাজেটে তার বড় স্বপ্ন দেখার অনুকূলে। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। আগামী জুলাই থেকে শুরু হতে চলা নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিকে চাঙ্গা করার আগে তাকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ গঠন, ভর্তুকির খরচ পরিশোধ এবং বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মতো বড় কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। নতুবা বাজেট প্রতিবছরের মতো অবাস্তবায়িতই থেকে যাবে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের লক্ষ্য ভালো। কিন্তু বিদ্যমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে বাজেটের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হবে না। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, মূল্যস্ফীতি ছাড়াও আমদানি ব্যয় বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর অর্থনীতির ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সার, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশে উন্নীত করতে হয়। সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দ আরও বেড়ে জিডিপির ২ দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা যুদ্ধের আগে ভর্তুকি-প্রণোদনা খাত ঘিরে জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে সীমিত ছিল। একই সঙ্গে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় হ্রাস, বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, লেনদেন ভারসাম্যে অবনতি, রিজার্ভের নাজুক পরিস্থিতি, ডলার সংকট, তারল্য ঘাটতি এবং সরকারের সুদ ব্যয় বৃদ্ধির কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ অবস্থায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ধরে রাখা কঠিন হবে বলেও জানান তিনি। তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি। বৈশ্বিক জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্য এবং সারের দাম কমে আসতে শুরু করায় আগামী অর্থবছর মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি রাখতে পারবে সরকার। এ ছাড়া স্বল্প আয়ের জনগণের ওপর প্রভাব প্রশমনের জন্য সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, খোলাবাজারে চাল বিক্রয় এবং ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের মতো কার্যক্রমগুলো পরিচালনা অব্যাহত রাখবে বলে স্পষ্ট হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল—এটিকে গরিববান্ধব বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ফলে গরিবের ওপর বিশেষ কোনো চাপ নেই। আবার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার জন্যই এই বাজেট তৈরি হয়েছে।
উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কল্যাণে পূর্বের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসব। ফলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।
এ লক্ষ্যে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়—ক্রমান্বয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি থেকে বের হয়ে এসে মেগা প্রকল্পসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারক চলমান ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াবে সরকার। এজন্য সরকারি বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে নিষ্কণ্টক জমি, উন্নত অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন সেবা, আর্থিক প্রণোদনা ও সহজ ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধাসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া লজিস্টিক খাতের উন্নয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কারের ফলে বিনিয়োগ বা ব্যবসা প্রক্রিয়াকরণের সময়, ব্যয় ও জটিলতা কমবে। ফলে চলতি বছর বিনিয়োগ কিছু কমলেও আগামী অর্থবছর তা বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৭.৪ শতাংশে উন্নীত হবে।
রাজস্ব আয় বাড়াতে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব খাতের নীতি কৌশলের ওপর জোর দিয়েছেন। বলেছেন, সব সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। এ লক্ষ্যে রিটার্ন দাখিল সহজ, সংস্কারের মাধ্যমে করজাল বৃদ্ধি, কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, স্বয়ংক্রিয় ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে মূল্য সংযোজন কর আদায় সহায়ক ইএফডি স্থাপন ও সম্প্রসারণ, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন এবং কর প্রশাসনের অটোমেশন করে রাজস্ব আয় বাড়ানো হবে। এ ছাড়া করবহির্ভূত রাজস্ব খাতে ফি বা হার হালনাগাদকরণ, সম্ভাব্য উৎসগুলো চিহ্নিতকরণ, বিভাগগুলোকে সক্রিয় করাসহ ব্যয় দক্ষতা ও টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেবেন তিনি।
তবে শঙ্কার কারণ হলো, বাজেটে রাজস্ব সংক্রান্ত কিছু পদক্ষেপ জনজীবনে ব্যয়ের মাত্রা বাড়াবে। বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি খাতের ৪৪ ধরনের সেবার জন্য রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এখন সেবাপ্রত্যাশীদের ওপর ২০০০ টাকা করারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাটের বড় লক্ষ্য অর্জনে কলমের ওপর ১৫ শতাংশ, গৃহস্থালি পণ্যে আড়াই শতাংশ হারে ভ্যাটসহ টয়লেট টিস্যু, কিচেন টাওয়েল, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সাধারণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যবসার ব্যয় বাড়বে এবং পণ্য ও সেবার দামও বাড়বে। যার প্রভাবও জনজীবনেই পড়বে। রিজার্ভ পুনর্গঠনে সঠিক মূল্যে পণ্য আমদানি নিশ্চিত করা হবে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রবাসীদের আয় পাঠাতে উৎসাহ দেওয়া হবে। এ রকম আরও কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।