ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৭ জুন, ২০২৩ ০৯:২৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ২৩৭ বার
একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আরিফ হোসেন। তার ব্যবসার প্রসারের জন্য সম্প্রতি একটি ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ চেয়ে আবেদন করেন; কিন্তু প্রথম দফায় পাননি কাঙ্ক্ষিত ঋণ। তদুপরি এই ঋণ পেতে তার কাছে তিনজন গ্যারান্টারের স্বাক্ষর, ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্সসহ আরও নানা ধরনের কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে, যা আরিফের পক্ষে জোগাড় করা কস্টসাধ্য বিষয়।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক নিশ্চয়তা আমাকে নিশ্চিত করতে হয়। পরে যখন ঋণ আবেদনটি মঞ্জুর হলো, তখন আমার ব্যবসায়িক উদ্যোগটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু আরিফ হোসেন নয়, তার মতো দেশের বেশিরভাগ এসএমই উদ্যোক্তারাই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতায় খুব বেশি দূর এগোতে পারেন না। যারা পেয়ে থাকেন, তাদের নানাভাবে হতে হয় ভোগান্তির শিকার।
জানা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এসএমই খাতের অবদান বাড়ছে। ২০১৯-২০ বছরে জিডিপিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান ছিল ১ লাখ ২৫৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলো বড় ঋণ দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করলেও ছোটদের ঋণ দিতে চায় না। যদিও দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভূমিকাই বেশি। বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এসএমই উদ্যোক্তারা চাপে থাকলেও স্থানীয় শিল্পের বাজার বিকাশের পথও তৈরি হয়েছে। তাই এসএমই উদ্যোক্তাদের বিকাশে দেশের ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। সেইসঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমই উদ্যোক্তাদের সুরক্ষায় ঋণ প্রদান সহজ করা ও নীতি সহায়তা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলো তাদেরই ঋণ দিতে চায়, যারা বড় ঋণ নিতে চায় এবং ফেরত দেওয়ার নিশ্চয়তা কম। এতে তাদের বড় অঙ্কের কমিশনের সুযোগ থাকে; কিন্তু এসএমই উদ্যোক্তারা ছোট ছোট ঋণ নিতে চায়। তারা ঋণ নেওয়ার আগেই ঠিক করে কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবে। ফলে এসব ঋণে খেলাপির হার কম। এসব ঋণে ব্যাংকের কমিশনেরও সুযোগ নেই। তাই ব্যাংকগুলো এসব ঋণ দিতে খুব বেশি আগ্রহী হয় না। অথচ খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য এসএমই খাতেই বেশি ঋণ বিতরণ করা উচিত।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি মো. সামীর সাত্তার বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া আরও সহজ করা প্রয়োজন। নথিপত্রের জটিলতার কারণে এসএমই উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় ঋণ নিতে পারেন না। একই সঙ্গে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে আলাদা করে বিবেচনার পরামর্শ দেন তিনি। জানা গেছে, করোনার কারণে ২০২০ সালে ব্যবসায় যে ধাক্কা এসেছিল, তা পরবর্তী এক-দেড় বছরে অনেক প্রতিষ্ঠানই সামলে ওঠে; কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ব্যবসায় আবার নতুন করে সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা পড়েছেন বেশি সমস্যায়।
তাদের সংকট সমাধানে ঋণ প্রাপ্তি যেন সমস্যা না হয় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের এপ্রিলে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করে সরকার। এসব ঋণে গ্রাহকদের সুদ দিতে হয় ৪ শতাংশ। এ ছাড়া তাদের ঋণ আদায়েও বেশকিছু ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছর শেষে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২০ শতাংশের মতো। আগামী বছরেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, জাতীয় শিল্পনীতিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ব্যাংক ঋণের ২৫ শতাংশ দিতে হবে এসএমই খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় এসএমই উদ্যোক্তাদের বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই এ খাতের উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ব্যাংক শাখায় বিশেষ ডেস্ক স্থাপন, কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা, ঋণের আবেদন ও জামানত সহজীকরণ, ঋণসীমা বাড়ানো উল্লেখযোগ্য। এর ফলে ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানমুখী হয়েছেন, চড়া সুদের পরিবর্তে কম সুদে ঋণ পেয়ে ব্যবসা করতে পারছেন। জানা গেছে, এসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই বিভাগের হেড সৈয়দ আবদুল মোমেন বলেন, আমাদের ঋণের ৫৩ শতাংশই এসএমই খাতে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে এ খাতে ২৬ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির আশা করছি। এই ঋণের চাহিদা আছে, বিতরণও ভালো হচ্ছে। আবার আদায়ও ভালো। ঋণপত্র খুলতে কিছুটা সমস্যা ও খরচ বাড়লেও এসএমই উদ্যোক্তারা ভালো করছেন।