ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৪ অগাস্ট, ২০২৩ ১০:০৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩২২ বার
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি বিশ্বব্যপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। বন্যা, খরা এবং অন্যান্য চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর ক্রমবর্ধমান ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাব্য বিপর্যয় ও শস্যের ঘাটতির সতর্কতা জারি করেছে।
যদিও জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবুও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকেই প্রায়ই বর্তমান ক্ষুধা সংকটের তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে অবশ্যই এটি একটি রেড সিগনাল।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যুদ্ধটি রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ের গম রপ্তানিকে ব্যাহত করেছে, যা বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলেছে। ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বের প্রধান দুই খাদ্যশস্য উৎপাদক দেশ। বিশ্বব্যাপী গম রপ্তানির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আসে এই দুটি দেশ থেকে।
নীতিনির্ধারক এবং আলোচকরা ২০২২ সালের গোড়ার দিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মূলত সংঘর্ষের কারণে সরবরাহের ঘাটতিকে দায়ী করেছেন।
রাশিয়ার আগ্রাসনের পরের কয়েক মাসে বিশ্বব্যাপী গমের মূল্য সূচক প্রায় ২৩% বেড়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের জুনে আবার দাম কমতে শুরু করে। একই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ গমের মূল্য যুদ্ধপূর্ব পর্যায়ে ফিরে আসে।
এই সময়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে শস্য রপ্তানি প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ে ছিল, যাকে ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ (বিএসজিআই) এর সাফল্য হিসেবে ধরা যায়। এটি জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি চুক্তি যার ফলে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির ওপর থেকে রুশ অবরোধ তুলে নিয়েছিল মস্কো।
বিপরীতভাবে, এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাশিয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী শস্য সরবরাহকে আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহ স্থিতিশীল রয়েছে। এই সময়ে বিশ্বে মোট গমের চাহিদা এবং সরবরাহ প্রায় সমান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে দেখানো হয় জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ সময়কালে যখন গমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল তখন–বিশ্বব্যাপী গমের উৎপাদন পাঁচ মিলিয়ন টন বেড়েছে। একই সময়ে বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়েছে তিন মিলিয়ন টন এবং গমের স্টকও সামান্য বেড়েছে (প্রায় তিন মিলিয়ন টন)।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্বে মোট গমের সরবরাহ ২৭৫ মিলিয়ন টন অতিক্রম করেছে যা বিশ্বের মোট চাহিদার চেয়ে বেশি। একইভাবে, জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ এর মধ্যে বৈশ্বিক গমের সরবরাহ ১ বছরে বৈশ্বিক মোট চাহিদাকে অতিক্রম করেছে এবং এই প্রবণতার চলমান রয়েছে।
সুতরাং বিশ্বে খাদ্যশস্যের ঘাটতির যে আলাপ উঠছে তা একটি মিথ এবং এটি একটি মিথ্যা প্রচারণা।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য এলাকার উৎপাদন ও বাণিজ্য বৃদ্ধিকে উপেক্ষা করে সরকার এবং মিডিয়া নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ঘাটতিকে বড় করে দেখায়। বাস্তবে, বিশ্বব্যাপী গমের উৎপাদন হয় এবং একটি অঞ্চলে ঘাটতি অন্য অঞ্চলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে তা পূরণ করা যায়।
যেহেতু উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই তাহলে গমের দাম বাড়ার কারণ কী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের বিশ্বের বৃহত্তম চার শস্য ব্যবসায়ী কোম্পানির দিকে তাকাতে হবে। আর্চার-ড্যানিয়েলস-মিডল্যান্ড, বুঞ্জ, কারগিল এবং লুই ড্রেফাস–এই চার কোম্পানিই বিশ্ব খাদ্যশস্য বাজারের ৭০% এর বেশি নিয়ন্ত্রণ করে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, বিশেষ করে ২০২২-এর মার্চ থেকে জুনের মধ্যে, এই বিগ ফোর শস্য ব্যবসায়ীরা রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা এবং রাজস্ব সংগ্রহ করে। কার্গিলের বার্ষিক মুনাফা ২৩% বেড়ে ১৬৫ বিলিয়ন ডলার হয়। একই সময়ে লুই ড্রেফাসের মুনাফার পরিমাণ বাড়ে ৮০%।
খাদ্যশস্যের বাজার থেকে তাদের এই বিশাল মুনাফা প্রমাণ করে, বিশ্বে খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল না বরং সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করেছিল কোম্পানিগুলো। যা এখনও চলমান রয়েছে এবং এটাকে বলা যায় গমের ভেতরে ভুত।
ইউক্রেনের বেশিরভাগ শস্য রপ্তানি হয় বিশ্বের দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ২০২২-২৩ সালে ইউক্রেন থেকে বের হওয়া বেশিরভাগ শস্য দরিদ্র দেশগুলোতে পৌঁছায়নি।
পরিবর্তে, বিএসজিআই-এর অধীনে রপ্তানি করা ৩২.৯ মিলিয়ন টনের ৮১% উচ্চ-আয়ের এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গেছে। বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ যেমন- স্পেন, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডস, পাশাপাশি চীন এবং তুরস্কে গেছে এসব শস্য। এই সময়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির মাত্র ৩% গেছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশে এসেছে ৯%।
খাদ্য-আমদানিকারী আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে ইউক্রেনের বড় ধরনের শস্য রপ্তানি চুক্তি রয়েছে। কিন্তু ২০২২-২৩ বছরে ইউক্রেনের রপ্তানির মাত্র একটি ভগ্নাংশ পেয়েছে তারা। সুতরাং চুক্তি রক্ষা করেনি রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই চুক্তি ভাঙন মহাদেশজুড়ে ব্যাপক অনাহারের দিকে পরিচালিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিএসজিআইকে বিশ্ব ক্ষুধা মোকাবিলার চেয়ে ইউক্রেন থেকে রপ্তানি সহজতর করার বিষয়ে বেশি মনোযোগী বলে মনে হয়।
ইউক্রেনের সামুদ্রিক রুটের ওপর রুশ অবরোধ ছাড়াও, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং রোমানিয়ার মতো মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর অন্তর্নিহিত আমদানি বিধি-নিষেধগুলো আপস করা হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য স্থানীয় কৃষকদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা বেড়েছে, কিন্তু এটি কোনোভাবেই শস্যের অভাবের কারণে নয়। বরং, রপ্তানি হ্রাস, বিদেশি-বিনিময় রাজস্ব হ্রাস, মূলধন ফ্লাইট এবং উচ্চ ঋণ-পরিষেবা ব্যয় অনেক দেশের খাদ্যসামগ্রী আমদানির ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে।
এই চ্যালেঞ্জগুলআ মোকাবিলা করার জন্য, আমাদের অবশ্যই আমাদের ফোকাস পরিবর্তন করতে হবে। দাতব্য হিসেবে শস্য বিতরণের পরিবর্তে, বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই দরিদ্র দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার দুর্বলতা প্রশমিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আমরা এখনও বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে পারি, তবে তা শুধু তখনই সম্ভব- যদি আমরা আমাদের বর্তমান দুর্দশার আসল কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে পারি।