ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:৫২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১২৭ বার
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সফল সংগঠক মরহুম জননেতা শেখ তজমুল আলী চেয়ারম্যানের ২৫ তম মৃত্যবার্ষিকী আজ। ১৯৯৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি, এই দিনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ফেঞ্চুগঞ্জ থানা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ২নং মাইজগাঁও ইউনিয়নের সাবেক জননন্দিত এই চেয়ারম্যান মৃত্যুবরণ করেন। ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি-
সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন : শেখ তজমুল আলী চেয়ারম্যান ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ২নং মাইজগাঁও ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- শেখ হাছন আলী, মাতা- শেখ মজিরুন্নেসা। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে তজমুল আলী চতুর্থ। ষাট থেকে নব্বই দশকের রাজনীতিতে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে বেড়ে ওঠা এই সাংগঠনিক কৌশলী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহ ও আস্থাভাজন একজন নেতা ছিলেন।
১৯৬৮ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে সরাসরি ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ; এবং ঐ বছরই তিনি তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ফেঞ্চুগঞ্জ থানা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯৭০, মাইজগাঁও স্টেশনের এক বিশাল জনসমক্ষে তিনি বঙ্গবন্ধুকে মানপত্র প্রদান করেন এবং তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তা পাঠ করে শুনান। ৫ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে লিখা পত্রে শেখ তজমুল আলী বিস্তারিত বিবরণী সহ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সেই স্বর্ণালী মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তজমুল আলীকে জনসম্মুখে ডেকে তার মাথায় হাত বুলান ও নিজের সহচরদের একজন করে নেন।
১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানা সমন্বিত আসনে বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী এবং ১৭ই ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এডভোকেট লুৎফুর রহমান প্রার্থী হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব নির্দেশনানুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পেয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচারণা চালান শেখ তজমুল আলী। একইসাথে তিনি আতাউল গণি ওসমানীর পক্ষে প্রথমে ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ এবং পরে গোলাপগঞ্জে অনফিল্ড প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন৷
২৩ মার্চ ১৯৭১, তাঁর নেতৃত্বে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা পুলিশ ক্যাম্প এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয় এবং ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানী দোসরদের বিতাড়িত করা হয়।
১৯৭১, মুজিব বাহিনীর অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে স্বাধীন বাংলা গঠন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মনোনীত হোন এবং প্রথম সারির নেতা হিসেবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সফল সমন্বয়ক ও জেনারেল ওসমানীর সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বহুবার তজমুল আলীর বাড়ি আক্রমণ করে এবং পুড়িয়ে দেয়।
স্বাধীন বাংলার প্রথম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরপর তিন মেয়াদে (৭৯ তে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন) একই দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলার প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বাঘ প্রতীক নিয়ে তজমুল আলী সর্বকনিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হোন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ের চেয়ারম্যান অপেক্ষা তিনি অধিক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
একই সনে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী ফেঞ্চুগঞ্জ নেমেই তজমুল আলীর তলব করেন। “আমি তজমুল কে দেখছিনা, খবর দাও” বলে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎ করেন।
স্বাধীন বাংলার প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়ান ফরিদ গাজী সিলেট সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হলে তিনি জননেতা তজমুল আলীকে ডেকে পাঠান। বিপুল ভোটে নির্বাচিত দেওয়ান ফরিদ গাজী তজমুল আলীকে নিজের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৯৭৪, জেনারেল (অবঃ) এমএজি ওসমানী ফেঞ্চুগঞ্জে আসলে তৎকালীন সময়ে গ্যাস এলাকার কিছু লোককে সারকারখানায় কোটাভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার দাবি তুলেন তজমুল আলী। এতে ওসমানীর উপস্থিতিতে তাঁর মাধ্যমে সর্বপ্রথম পাঁচজন স্থানীয় লোকের চাকুরি হয়। এছাড়াও ফেঞ্চুগঞ্জের কচুয়াবহর, মির্জাপুর, পানিসাইল, মাইজগাঁও, চেলারচক, বকশিপুর, বারহাল, শিমুলতলা, কর্মদা ও নিজামপুর গ্রামকে সারকারখানার নির্গত দূষিত বর্জ্য গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা চিহ্নিত করে ও দুর্গত চিলুয়া বিল হাওরকে ফসলী ও জমির পরিমাণে নির্দিষ্ট হারে প্রথম বারের মতো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।
একই সনে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ থানা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন এবং আমৃত্যু সংগঠনের সেই দায়িত্ব পালন করেন। ৭৪’র মাঝামাঝি সময়ে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে দুর্ভিক্ষ নিরসনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে সংগঠনটি।
আগষ্ট ১৫, ১৯৭৫- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যার পর তৎকালীন সামরিক সরকারের সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তিনিই থানা আওয়ামী লীগের সর্বপ্রথম সভা আহবান করেন। সকল বাধা উপেক্ষা করে তিনি প্রতিবাদ করেন এবং জনসম্মুখে মিলাদ মাহফিল পড়ান।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করে দলকে এগিয়ে নেয়ায় তিনি তৎকালীন সামরিক শাসিত সরকার কর্তৃক বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হোন। ১৪৪ এর শান্ত আইন ভাঙতে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে মৃত্যুমুখে ডাকবাংলায় জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৭৭-৭৯, তিনি পুনরায় ইউপি সদস্য নির্বাচিত হোন এবং এলাকার উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষিত অভিনন্দন পত্র গ্রহণ করেন। ১৩ জুলাই ১৯৭৯ সালে তিনি আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দলপতি পত্র (সম্মাননা স্মারক) গ্রহণ করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি পুনরায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে বিএনপির জয় জয়কার হলেও ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ইনামুল হক চৌধুরী (বীর প্রতীক) ৩হাজার ৫শ ৭৩ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী ফতেহ ইউনুছ খানকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে নৌকার প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ তজমুল আলী।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০, অগ্রজ জমির উদ্দিনকে আহবায়ক ঘোষণা করে নিজে ফেঞ্চুগঞ্জ থানা শ্রমিকলীগের ১ম যুগ্ম আহবায়ক ও একইসাথে সারকারখানা শ্রমিকলীগের সভাপতি নির্বাচিত হোন এবং শ্রমিকদের দাবি আদায়ে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন।
২৯ মে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ট্রেনযোগে ফেঞ্চুগঞ্জে এসে পৌঁছালে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রের জাল বিছায়। হামলা হয় তাঁর উপর। বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরাপত্তায় সেদিন তজমুল আলীর সূক্ষ, সাহসী ও কৌশলী নেতৃত্ব প্রশংসা কুড়িয়েছিলো সর্বমহলে।
২রা জুলাই ১৯৮৩ সালে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল এম এ সামাদ ফেঞ্চুগঞ্জ আসলে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বৃহত্তম হাকালুকি হাওর তীরবর্তী লাখ লাখ একর জমির ফসল রক্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রন প্রকল্প গ্রহণ, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার রক্ষা প্রকল্প, এশিয়ান হাইওয়ের সাথে পাকা রাস্তার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং ফেঞ্চুগঞ্জ থানার একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রী কলেজকে সরকারীকরণের দাবি জানান।
১৯৮৪, তিনি সিলেট সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৪ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গ্রুপভিত্তিক রাজনীতি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হলে শেখ তজমুল আলী সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলারদের সম্মতিক্রমে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখে অবগত করেন। তাঁর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা গঠনতন্ত্রবিরোধী সেই কমিটি বাতিল করেন। সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে তিনি সিলেট বিভাগব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে জোর ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৬ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সম্মেলনে কলেজ ছাত্রলীগ সেক্রেটারি আব্দুল বাছিত টুটুলের সভাপতিত্বে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ তজমুল আলী, আব্দুল লতিফ, ডা. মিনহাজ উদ্দিন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ (পরবর্তীতে ডাকসু ভিপি) সহ তৃণমূলের বেশ কয়েকজন একই মঞ্চে দেখা যায়। ১১ই এপ্রিল ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রাকৃতিক গ্যাস সারকারখানা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হোন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর প্রত্যক্ষ অনুমতি সাপেক্ষে দলের ভিত্তি মজবুতকরণের লক্ষ্যে তিনি ২নং মাইজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি সেচ্চায় থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মাইজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯১-১৯৯৩, ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা রক্ষার প্রশ্নে শেখ তজমুল আলী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা গণদাবী পরিষদ সুগঠিত হয়। বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে রেখে তিনি নিজে যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং সারকারখানা রক্ষা আন্দোলনে রাজপথ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। যেখানে ডাঃ মিনহাজ উদ্দিন, জমির উদ্দিন, লুৎফুর রহমান ও আব্দুল বারী তাঁর ঘনিষ্ট পরিকল্পনা সঙ্গী ছিলেন। শিল্প মন্ত্রনালয় ঝুঁকিপূর্ণ অজুহাত দিয়ে সার্কুলেশনের মাধ্যমে সারকারখানা বন্ধের সিন্ধান্ত নিলে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুস সামাদ আজাদ সহ বৃহত্তর সিলেটের ১৮ জন সাংসদ সারকারখানা মাঠে বিশাল প্রতিবাদ সভায় জড়ো হোন। প্রথম সারি থেকে নেতৃত্ব দেন তজমুল আলী। তাঁর শিশুসন্তান বর্তমান শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ দিদারুল শিহাব সেদিন ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন আহমদ নেওয়াজের কোলে ওঠে গর্জে ওঠা জনস্রোতে যে বক্তব্য রাখেন, সেটা সকল নেতৃবৃন্দন্দের অবাক করে দেয়। ফেঞ্চুগঞ্জবাসী সফল হোন ; রক্ষা পায় ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা।
১১ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে তিনি সারকারখানায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার কল্যাণ কমিটি গঠন করে সেটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লোভ-লালসার উর্দ্ধে গিয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের কল্যাণে তার সৎ নীতিতে অটল থাকা ও আত্মত্যাগ প্রশংসিত হয় সর্বমহলে। ১৬ জুলাই ২০২০ তারিখে এক অডিও বার্তায় নাসির উদ্দিন রতন বলেন- ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা যদি কোনো রাজ্য হতো, তাহলে সেটির রাজা হতেন শেখ তজমুল আলী। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সারকারখানা রক্ষা, স্থানীয় শ্রমিকদের চাকুরি ও কল্যাণে তজমুল আলীর নিঃস্বার্থ অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তজমুল আলীর আদর্শ, নীতি ও দৃঢ়তার ফসল হচ্ছে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা।
১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মাইজগাঁও থেকে চেয়ার প্রতীক নিয়ে ২২ ভোট ব্যবধানে প্রতিদ্বন্ধী সুফিয়ানুল করিম চেীধুরীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হোন শেখ তজমুল আলী। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
চেয়ারম্যান তজমুল আলীর গুরুতর অসুস্থতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রথম সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ ও বিএমএ সেক্রেটারি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ডাঃ মহিউদ্দিন ও চিকিৎসক ডাঃ শেখ গোলাম মোস্তফার পরামর্শে তাঁকে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে আল রাজী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, কৃষক লীগ নেতা ছবি বিশ্বাস সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অসুস্থ তজমুল আলীর খোঁজ-খবর নিতে নিয়মিত হাসপাতালে যাতায়াত করতেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও সিলেট-৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহমুদ উস সামাদ চেীধুরীর তত্ত্বাবধানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে ২২ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪ ঘটিকায় ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা মাঠে দেওয়ান ফরিদ গাজী সহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দদের সহযোগে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুপস্থিত জননেতা তজমুল আলীর জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। ১৬ই মার্চ তজমুল আলীকে দেখতে বিএনপি নেতা ও ৯১’র নির্বাচিত সাংসদ শফি আহমদ চেীধুরী সহ বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দগণ ঢাকাস্থ আল রাজী হাসপাতালে যান। ১৯৯৮ সালের ৪ অক্টোবর শেখ তজমুল আলী নিজের শারীরিক অবস্থা ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর খোঁজ নেন এবং উল্লেখিত বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করেন। একইসাথে কতিপয় রাজনৈতিক ও আইনি সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২৯ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে যখন তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত, তখনও তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ থানা ক্রিয়া সংস্থার উপদেষ্টা এবং থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সব ধরণের রাজনৈতিক, সামাজিক, বিচার-শালিস ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় থাকেন। তৎকালীন সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবাদুর রহমান টিটু ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এ. এস এম রাশিদুল হাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ফেঞ্চুগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পানি সমস্যা নিরসনে কাজ করেন। তজমুল আলী কচুয়াবহর যুব সংঘ সহ অসংখ্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনের মান উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর ঘনিষ্টজন আরফান আলী, আব্দুল লতিফ, ডাঃ মিনহাজ উদ্দীন, ডাঃ আর কে দাস সহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তজমুল আলী এসএসসি পাশ করেন কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং তিনি একাধিকবার ফেঞ্চুগঞ্জ থানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সভাপতি নির্বাচিত হোন। বিভিন্ন সালিশে দল মত নির্বিশেষে তজমুল আলীর দৃঢ় সিদ্ধান্ত স্থানীয় ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে আলোকিত করেছিল। বিভিন্ন সময়ে নারী-শিশু-শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে তজমুল আলী তাঁর অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেন। ফেঞ্চুগঞ্জ ফাউন্ডেশনের ভিত্তি মজবুতকরণে বিশেষ অবদান সহ গ্রাম এলাকায় বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় নিজ গ্রাম মির্জাপুরে কচুয়াবহর-মির্জাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্ব‘পূর্ণ অবদান রাখেন তজমুল আলী। অতি অল্প সময়ে দেশের শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানদের অন্যতম একজন নির্বাচিত হওয়া সহ ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা বর্জ্য পদার্থ সম্পৃক্ত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে তজমুল আলী চেয়ারম্যান অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। নিজ এলাকার পরিবেশ রক্ষায় প্রথম ইউপি চেয়ারম্যান তিনিই, যিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা কর্তৃপক্ষকে আপত্তি পত্র দাখিল করেন। স্বার্থান্বেষী মহল তাকে বস্তাভর্তি টাকা, গাড়ি-বাড়ি, পরিচিতজনদের সারকারখানায় চাকুরি সহ নানা প্রলোভন দেখালেও তজমুল আলী তার নীতি থেকে চুল পরিমাণ নড়েন নি ; যে কারণে তাঁর মৃত্যুর ২৪ বৎসর পরও নিজ দলীয়, বিরোধীদলীয় কিংবা নির্দলীয় ব্যক্তিরাও তাকে আদর্শের মাইলফলক বলে আখ্যায়িত করেন। ২৯ নভেম্বর ১৯৯৭, দৈনিক মানচিত্রের ভাষ্যমতে তজমুল আলী এমন এক নেতা, যিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের গান গেয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ মানুষের জন্য এবং সবার ওপরের মানুষ সত্য। এলাকার উন্নয়নে তজমুল আলী চেয়ারম্যান প্রত্যেক এলাকা ঘুরে এলাকার মুরব্বীয়ান এবং যুবকদের নিয়ে প্রথমে এলাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতেন এবং পর্যায়ক্রমে গুরুত্ব অনুসারে সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
১০ মার্চ ২০০১ সালে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে লিখা চিঠিতে তাঁর সহধর্মিণী সমাজ উন্নয়নে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননায় ভূষিত শেখ আফিয়া খানম উল্লেখ করেন, তজমুল আলী বাক্যে নয়, কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তজমুল আলীর সহধর্মিনীকে গণভবনে ডেকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করেন। ১৯৯৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ থানা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক, মাইজগাঁও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মাইজগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। স্বল্প সময়ে সুনাম অর্জন করা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইউপি চেয়ারম্যানদের একজনের মৃত্যুতে সিলেট জুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। অবরোধ চলাকালীন জানাযার নামাজে ট্রাক ভর্তি মানুষ ছুটে আসেন সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ; ঢাকায় আটকা পড়েন আব্দুল বাছিত টুটুল সহ অনেকেই।
বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী চলমান কড়া অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এম সাইফুর রহমানের নির্দেশনায় সিলেট থেকে কুলাউড়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি শিথীল ঘোষণা করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন রতনের ভাষ্যমতে, হরতাল আবরোধ উপেক্ষা করে তজমুল আলীকে শেষ বিদায় জানাতে নেমে আসা জনতার স্রোত দেখে মনেই হচ্ছিলো না, তজমুল আলী আর আমাদের মধ্যে নেই। ভেঙে পড়েন ডাঃ মিনহাজ উদ্দিন। রাজনীতিতে ইতি টানেন নাসির উদ্দিন রতন।
আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফুর রহমান, সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেসা হক, হবিগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ শাহনেওয়াজ মিলাদ গাজী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খানের এক যৌথ বিবৃতিতে শেখ তজমুল আলী চেয়ারম্যানকে স্মরণ করা হয়। প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেসা হক বলেন, এ যুগে আরেকজন তজমুল আলীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি জমি বিক্রি করে, পায়ে হেঁটে আওয়ামী লীগ করেছেন। পদ-পদবী, ক্ষমতা কিংবা অর্থের লোভে রাজনীতি করেন নি। দল ও দেশের জন্য তাঁর অবদান মানুষ কোনোদিনই ভুলবে না। ত্যাগ ও আদর্শে অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।
২রা জানুয়ারি ২০২২, ফেঞ্চুগঞ্জের ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ও সারকারখানা-জেটিঘাট সংযোগ কচুয়াবহর পালবাড়ি এলাকায় "জননেতা শেখ তজমুল আলী চত্বর" এর নামফলক উন্মোচনকালে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, তজমুল আলী যখন আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে, কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। শুধু দলের জন্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করেছেন। জাতির পিতার স্নেহধন্য ও তাঁর চিন্তা-চেতনাকে অন্তরে লালন করে আমৃত্যু জনকল্যাণে নিবেদিত থাকা এই মুজিব সৈনিকরাই আমাদের পথ চলার শক্তি, আমাদের আদর্শ।
লেখক- শেখ এফ এইচ ফারহান, কলামিস্ট
তথ্যসূত্র, সংশোধন ও সমন্বয়-
(১) এডভোকেট মো. লুৎফুর রহমান, সাবেক সাংসদ (ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ, ১৯৭০) ; গণপরিষদ সদস্য ১৯৭২
(২) সৈয়দা জেবুন্নেসা হক, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
(৩) বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান, গণপরিষদ সদস্য ১৯৭২
(৪) রশিদ আহমদ (ফিজিক্যাল স্যার)
(৫) বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন রতন, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, স্বাধীন বাংলা ছাত্রলীগ, ফেঞ্চুগঞ্জ থানা।
(৬) আব্দুল বাছিত টুটুল, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।