ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

অগ্নিবোমা ২৫০০ ভবন

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৪ মার্চ, ২০২৪ ১০:০৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১১৬ বার


অগ্নিবোমা ২৫০০ ভবন

রাজধানীর ফার্মগেটের সেজান পয়েন্ট মার্কেট। ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় এই শপিংমলটি অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ। একই তালিকায় আছে মাহবুব প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স, ফার্মভিউ সুপার মার্কেট, ক্যাপিটাল সুপার মার্কেট ও চৌরঙ্গী সুপার মার্কেটও। তবে এমন বিপদের কথা জানেন না এসব মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের কেউ। ফলে প্রতিদিনই মার্কেটগুলোতে ভিড় করছেন হাজার হাজার মানুষ।

শুধু ফার্মগেট নয়, ফায়ার সার্ভিসের তালিকা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকাজুড়ে আছে এমন ২ হাজার ৫১২টি ভবন। অনেকটা ‘অগ্নিবোমা’ হয়ে থাকা এসব ভবনে চলছে নানামুখী কার্যক্রম। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৮টি ভবনে রয়েছে মার্কেট ও শপিংমল। অন্যগুলো হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া হাউস।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ভবনে আগুন লাগলে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ, পুরান ঢাকার নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে রূপ নিতে পারে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, এক হাজার ৪৮টি মার্কেট, শপিংমল ছাড়াও অন্য ১ হাজার ৪৬৪টি ভবনের মধ্যে ৩৪৫টি হাসপাতাল ভবন সরেজমিন পরিদর্শন করে মাত্র ৭টিতে অগ্নিনিরাপত্তা পাওয়া যায়। অন্য ৩৩৮টি হাসপাতাল ভবনে অগ্নিঝুঁকির মধ্যেই চলছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। তার মধ্যে আবার ১২০টি হাসপাতাল ভবন রয়েছে অতিঝুঁকিতে, ২১৮টি ঝুঁকিপূর্ণ।

ঢাকায় আবাসিক হোটেলগুলোর মধ্যে ৩২৫টি আবাসিক হোটেলে তল্লাশি চালিয়ে মাত্র ৭টিতে মেলে অগ্নিনিরাপত্তা। অন্য ৩১৮টি আবাসিক হোটেলের মধ্যে অতিঝুঁকিতে ৭০টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে ২৪৮টি। ৮০১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) পরিদর্শন করে মাত্র ১৭টিতে অগ্নিনিরাপত্তা ঠিকঠাক পায় ফায়ার সার্ভিস। বাকি ৭৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৪টি অতিউচ্চঝুঁকিতে এবং ৭২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রাজধানীর মিডিয়া হাউসগুলোর মধ্যে ২৬টি পরিদর্শন করে ১৮টি পাওয়া যায় অতিউচ্চঅগ্নিঝুঁকিতে ও ৬টি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।

১০৪৮টি মার্কেটের মধ্যে অতিঝুঁকিতে ৫১২টি মার্কেট এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে ৬২২টি মার্কেট-শপিংমল।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, পরিদর্শন শেষে এসব ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কোনো জনসমাগম মার্কেট বা শপিংমলের সামনে নোটিশও টানিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ভবনগুলো যে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ, তা জানিয়ে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নোটিশের অনুলিপি দেওয়া হয়।

কেন শুধু নোটিশ দিয়েই শুধু দায় সারা হচ্ছে, জানতে চাইলে ফায়ার অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, নোটিশ দেওয়ার বাইরে তাদের আর ক্ষমতা নেই। এজন্য যাদের এনফোর্সমেন্ট ক্ষমতা রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোকে তারা নোটিশের অনুলিপি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে থাকেন।

এই কর্মকর্তা বলেন, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩-এ ফায়ার সার্ভিসকে মামলা, জরিমানা ও তল্লাশি করার মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে ওই আইনের বিধিমালা স্থগিত থাকায় তারা তা প্রয়োগ করতে পারছেন না। এ কারণে নোটিশ দেওয়া ছাড়া তাদের করার কিছু থাকে না।

ঢাকায় যেসব এলাকায় মার্কেট-শপিংমল ঝুঁকিপূর্ণ:

ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ঢাকার মার্কেটগুলোর মধ্যে গুলশান, বনানী, বসুন্ধরা, বারিধারা, বাড্ডা, ভাটারা ও কুড়িল এলাকায় ১১৮টি ভবন পরিদর্শন করে ওইসব এলাকায় অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৭৯টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৩৪টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। ওয়ারী, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, বংশাল, কাকরাইল, বেইলি রোড, বিসিসি রোড, শান্তিনগর এলাকায় ১০৪টি ভবন পরিদর্শন করা হয়। ওইসব এলাকায় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ১২টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৯০টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। মিরপুর, পল্লবী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, দারুসসালাম ও কাফরুল এলাকায় ১২৬টি ভবন পরিদর্শন করে। এ সময় ওইসব এলাকায় খুব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ৬৪টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৫৮টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় ৮৯টি ভবন পরিদর্শন করে সবকয়টি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

রাজধানীর মগবাজার, তেজগাঁও, মহাখালী ও কারওয়ান বাজার এলাকায় ৫৫টি ভবন পরিদর্শন করে ৩১টি অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ২৪টি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। খিলখেত, নিকুঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় ৯০টি ভবন পরিদর্শন করে ৫৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়। লালমাটিয়া, জিগাতলা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, গ্রিন রোড, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ৭৪টি ভবন পরিদর্শন করে খুব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ১৫টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৫৮টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। ডেমরা, সারুলিয়া, মালিবাগ, খিলগাঁও, পূর্ব রামপুরা ও মুগদা এলাকায় ১৫০টি ভবন পরিদর্শন করে সবগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে আবার ১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ। চকবাজার, লালবাগ, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় ১০০টি ভবন পরিদর্শন করে খুব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ৮৮টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ১২টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। সদরঘাট, ইসলামপুর, লক্ষ্মীবাজার, পাটুয়াটুলী এবং এর আশপাশের এলাকায় ১৪২টি ভবন পরিদর্শন করে ১৪২টি ভবনকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ ছাড়া ঢাকার সাভার, আশুলিয়া এবং টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় ১৪৩টি ভবন পরিদর্শন করা করে খুব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ৯৩টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৫০টি ভবন চিহ্নিত করা হয়।

পাঁচ হাজার ভবন পরিদর্শনে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত ২ হাজার:

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, তারা নিয়মিত ভবনগুলো পরিদর্শন করে নোটিশ দিচ্ছে। সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭৪টি বহুতল ভবন, শিল্প কারখানা, সরকারি ও বেসরকারি ভবন পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৯৪টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ও ৪২৪টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে নোটিশ দেওয়া হয়। এর আগের বছর ৫ হাজার ৮৬৯টি ভবন পরিদর্শন করে ১ হাজার ৬০৬টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৬১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে নোটিশ করা হয়। ২০২১ সালে ৫ হাজার ৫৬৭টি ভবন পরিদর্শন করে ১ হাজার ২৯২টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৫৩১টি ভবনকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন: ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে নেই অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম। এসব ভবনে নিয়ম অনুযায়ী জলাধার বা পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেই। এমনকি আশপাশেও পানির ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া অনেক ভবনে ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি নিয়ে প্রবেশের সুযোগ কম।

এর বাইরে ভবনগুলোতে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, বৈদুত্যিক সঞ্চালন লাইনের তার ঝুলিয়ে রাখা বা অনিরাপদভাবে রাখা, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা না করা, ভবনের নকশার বাইরে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া বা নতুন করে স্থাপনা তৈরি করে গমনাগমন পথ রুদ্ধ করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সিঁড়ি না থাকা, অগ্নিদুর্ঘনায় ব্যবহারের জন্য লিফট না থাকা ভবনগুলোকে অগ্নিঝুঁকির তালিকাভুক্ত করা হয়।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহামেদ খান কালবেলাকে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলো চিহ্নিত করে নোটিশ করা হয়। কিন্তু এই নোটিশেই আটকে থাকলে একের পর এক সর্বনাশ হতেই থাকবে। তাই নোটিশ পাওয়া ভবনগুলোর বিরুদ্ধে যাদের দায়িত্ব, তাদের অ্যাকশনে যেতে হবে।

তিনি বলেন, প্রয়োজনে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করতে হবে সিটি করপোরেশনকে, রাজউকের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে কঠোর একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, তাদের এনফোর্সমেন্ট ক্ষমতা না থাকায় পরিদর্শনে গেলেও ভবন মালিকরা তাদের খুব একটা ভয় পান না। অনেক সময় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া অভিযান চালানোর মতো জনবল ফায়ার সার্ভিসের নেই।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটা ভবনটির সংশ্লিষ্টদের তিনবার নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটেও অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেষ পর্যন্ত আগুনে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু নোটিশ পাওয়ার পর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।


   আরও সংবাদ