ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

পাহাড়ে ৩ ব্যাংকে কেএনএফের হানা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৪ এপ্রিল, ২০২৪ ১০:২২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৮২ বার


পাহাড়ে ৩ ব্যাংকে কেএনএফের হানা

বান্দরবানের থানচিতে গতকাল বুধবার দুপুরে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালিয়েছে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা। এ সময় তারা সোনালী ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং কৃষি ব্যাংক থেকে সাত লাখ টাকা লুট করে। তবে তারা কোনো ব্যাংকের ভল্ট খুলতে বা ভাঙতে পারেনি। থানচি থানার ওসি মো. জসিম উদ্দিন এসব তথ্য জানিয়েছেন।

 

এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে কেএনএফ সদস্যরা রুমার সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায়। এ সময় তারা ব্যাংকের ভল্ট খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যায়। অপহরণের ২৬ ঘণ্টা পরও গত রাত ১০টা পর্যন্ত অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যসহ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনার পর  সম্ভাব্য এলাকাগুলোতে যৌথ বাহিনী চিরুনি অভিযান শুরু করেছে।

হামলা, অপহরণ এবং টাকা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় গতকাল দুপুরে পুলিশের আইজি যখন রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ছিলেন, সে সময় রুমার পাশের উপজেলা থানচির সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে কেএনএফ সদস্যরা হামলা চালায়। সেখানেও তারা ভল্ট ভাঙতে না পেরে ক্যাশ কাউন্টার ও গ্রাহকদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে চলে যায়।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রুমার সোনালী ব্যাংকে হামলার সময় শতাধিক কেএনএফ সদস্য থাকলেও থানচিতে ছিল ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের সবার হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক লুটের ঘটনায় কেএনএফ জঙ্গি গোষ্ঠী জড়িত বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। এ নিয়ে সরকার সব কিছুই করবে।

গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

 

তিনি বলেন, ‘কুকি-চিন একটি জঙ্গি গোষ্ঠী। কুকি-চিনের তৎপরতা ইদানীং বেড়েছে। পুলিশের আইজির নেতৃত্বে একটি টিম সেখানে  রয়েছে। ব্যাংক লুট করে চলে যাওয়ার পর পুলিশ ও বিজিবি সেখানে অপারেশন চালাচ্ছে। সেনাবাহিনী সদস্যরাও যোগ দেবে।’

উদ্ধার হননি ম্যানেজার

পারিবারিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন মাধ্যমে তারা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে, কিন্তু তাঁর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী ও বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাইসুরা ইসরাত জানান, দুই বছর আগে তাঁর স্বামী নিজাম উদ্দিন রাসেলকে সোনালী ব্যাংকের বান্দরবান শাখা থেকে রুমা শাখায় বদলি করা হয়। তিনি সেখানে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। হঠাৎ করে তাঁকে অপহরণের ঘটনায় পুরো পরিবার মুষড়ে পড়েছে।

মাইসুরা ইসরাত অবিলম্বে তাঁর স্বামীকে উদ্ধারে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ এবং ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে রুমা উপজেলায় কর্মরত সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী গতকাল দিনভর কর্মবিরতি পালন করেন। দুপুরে তাঁরা রুমা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন।

পার্বত্য গণপরিষদ এই হামলার ঘটনার প্রতিবাদে বান্দরবান শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন।

যেভাবে অপহরণ

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলছে, অপহরণকারীরা পাহাড়ি চাঁদের গাড়িতে এসে হামলা চালায়। তারা রুমা উপজেলা কমপ্লেক্সের প্রবেশমুখে মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের মারধর করে টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। সেখান থেকে তারা নামাজ আদায়রত নিজাম উদ্দিনকে ধরে মসজিদের পাশে থাকা ব্যাংক কার্যালয়ে ঢুকে সিসি ক্যামেরা, কম্পিউটার এবং অভ্যন্তরে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা ম্যানেজারের চাবি দিয়ে ভল্ট খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যায়।

রুমায় ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজন জানায়, রাত ৮টায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর সন্ত্রাসীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের আশপাশে অবস্থান নেয়। তারা রুমা উপজেলা সদরে ঢোকার পথে বেথেলপাড়ার মুখে অবস্থান নেয়। এ সময় এই পথে আসা যানবাহন, মোটরসাইকেল ও পথচারীদের আটকে দেয়। সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নিচের দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখে। রুমা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মোড়েও সন্ত্রাসীরা এমন কাণ্ড ঘটিয়ে তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটি দল বেথেলপাড়ার দিকে, আরেক দল চান্দাপাড়া হয়ে চলে যায়। সন্ত্রাসীরা সংখ্যায় ১০০ জনের মতো হবে এবং তাদের মধ্যে প্রায় সবার পরনে কেএনএফের ইউনিফর্ম এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল।

পুলিশের ধারণা, সন্ত্রাসীরা এ অভিযান পরিকল্পনার সময় অনেক তথ্যকে সামনে রেখে এগিয়েছে। রুমা উপজেলায় রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত প্রায়ই লোডশেডিং থাকে। এ সময় উপজেলা কমপ্লেক্সে থাকা লোকজন মসজিদে তারাবির নামাজ আদায়ে যায়। মাসিক বেতন ও ঈদ বোনাস বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা এ সময় ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে। এটিকে হিসাবে ধরে তারা হামলার পরিকল্পনা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সোনালী ব্যাংকে টাকা লুট হয়নি

রুমার সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি। গতকাল দুপুরে ঢাকা থেকে সিআইডি কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভল্ট খুলে সেখানে রাখা এক কোটি ৫৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকা অক্ষত অবস্থায় পেয়েছেন। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহনেওয়াজ খালেদ এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

যৌথ অভিযান চলছে

রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার পর সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান শুরু হয়। এ ঘটনার পর পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এর আগে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সেখানে যান।

রুমায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় পুলিশের সক্ষমতা রয়েছে। আমরা যেকোনো মূল্যে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’

লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি

কেএনএফ গত মঙ্গলবার রাতে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখায় হামলা চালিয়ে পুলিশের ১০টি অস্ত্র এবং আনসারদের চারটি অস্ত্র ও চার শতাধিক বিভিন্ন অস্ত্রের গুলি লুট করে নিয়ে যায়। এসব অস্ত্র ও গুলি গত রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্রে জানা যায়।

এদিকে রুমা ও থানচি উপজেলায় সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলার পর বান্দরবান জেলা সদর ছাড়া ছয়টি উপজেলায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।

শান্তি উদ্যোগের মধ্যে এই হামলা

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি সূত্রে জানা যায়, কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) ঘটনাটি ঘটিয়েছে গত ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংলাপ এবং আগামী ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় তৃতীয় সরাসরি সংলাপের মধ্যবর্তী সময়ে। গত বছরের ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম সরাসরি শান্তি সংলাপে চার দফা সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে কেএনএফ। এতে বলা হয়, শান্তি সংলাপ চলাকালে তারা কোনো সশস্ত্র তৎপরতা চালাবে না। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারা সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা দেবে।

৫ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় শান্তি সংলাপে সাত দফা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এতে তৃতীয় সরাসরি সংলাপে আরো বড় ধরনের অগ্রগতির আভাস দেওয়া হয়। এসব সম্ভাবনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই সশস্ত্র হামলা কেএনএফের শান্তি উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বান্দরবানে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। ওই আস্তানায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কেএনএফের অর্ধশতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে গত বছরের মে মাসে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয়। এর পর থেকে কমিটি কেএনএফের সদস্যদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে আসছে।


   আরও সংবাদ