ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১১৭ বার
।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
২ ও ৩ এপ্রিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ ব্যাংক ডাকাতি করে বাংলাদেশের পার্বত্যঅঞ্চলে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে ? পরপর দুটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতি কুকিদের ভয়ংকর বার্তা হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসে। তবে পাহাড় যে একবারে শান্ত হয়ে গিয়েছিল তা বলা যাবে না। পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সাথে ইউপিডিএফসহ নানা সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মাঝে মাঝেই এই জনপদ রক্তাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এর মধ্যে প্রকাশ্যে জনপদে ঢুকে ব্যাংক ডাকাতি করা, ম্যানেজার ধরে নিয়ে যাওয়া, এলাকায় নিজেদের এই রকম সশস্ত্র উপস্থিতি জানান দেওয়া কোন স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।
সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের এমন বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে পার্বত্য অঞ্চলের জনজীবনে নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি এসব সংগঠন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও চরম হুমকি স্বরুপ। কুকি-চিনের পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো মদদ রয়েছে কি না সরকারকে তা খুজে বের করতে হবে।
মাত্র ১৫ ঘণ্টার মধ্য বড় আকারের দুটি ব্যাংকের তিন শাখায় লুট করা অবশ্যই নিরাপত্তাগত বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ঘটনাটিকে ‘ব্যাংক ডাকাতি‘ আখ্যা দেওয়া হলেও তা নিছক চোর-ডাকাতের মামুলী অপরাধকর্ম নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কুকি-চিন আসলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। পাহাড়ি-বাঙালিসহ সকলের মনে প্রশ্ন, সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ দেশে ব্যাংক লুটের সাহস পেল কোথায় ? শান্তিচুক্তি বিরোধী এই সংগঠনের সাথে যখন সরকারের শান্তির আলোচনা চলমান, তখন এই ধরনের হামলার মাধ্যমে কেএনএফ কী বার্তা দিতে চায়?
বাংলাদেশ থেকে পার্বত্যাঞ্চলকে পৃথক করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই কুকি-চিন সহ সকল সন্ত্রাসী সংগঠন ঐক্যবদ্ধ তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। পার্বত্যঅঞ্চল থেকে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সেনা ক্যাম্প সরিয়ে ফেলার সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই আজ তারা দুঃসাহস দেখাচ্ছে ? এ কারণে তাদের সঙ্গে কোন ধরনের আপোষ হওয়া উচিত নয়। যারা দেশবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত তারাই হুমকি। বহিঃবিশ্বের কোন কোন দেশ তাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। তাদের নির্মূল করতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না।
অভিযোগ রয়েছে, কুকি চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক নেতার সখ্যতা রয়েছে। এছাড়া একাধিক সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও নাকি তাদের গভীর গসাজস রয়েছে। কারণ তারা নিয়মিত কুকি চিনের কাছ থেকে চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কুকি চিনকে সুযোগ দেওয়া উচিত হয়নি। সুযোগ নিয়ে তারা গহীন অরণ্যে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করেছে। এখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আইন শৃংখলা বাহিনীর জন্য কষ্টদায়ক হবে। কারণ তারা যেখানে আস্থানা গেড়েছে, সেখানে যাতায়াত করা কঠিন। তারা সব চেনে। ওই সব এলাকায় যেতে এক দুই দিন লেগে যায়। আগে পুরো পাহাড় নিয়ন্ত্রণে ছিল। কুকি চিনের সঙ্গে জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার) ইউপিডিএফ (মূল), ইউপিডিএফ (সংস্কার)ও ইন্ধন যোগায়।
শুধু বাংলাদেশই নয়, দীর্ঘদিন ধরেই অশান্তির আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের মনিপুর অঙ্গরাজ্য। সেখানে স্থানীয় প্রশাসন ও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে স্থানীয় কুকি, নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। বান্দরবানের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের চিন প্রদেশেও সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে আসছে স্থানীয় কুকি চিন জনগোষ্ঠী। এ ছাড়া ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ডেও সংখ্যাগরিষ্ঠ এ জনগোষ্ঠী।
কুকি চিন নামধারী সশস্ত্র গোষ্ঠীর এসব বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে পার্বত্য অঞ্চলের জনজীবনে নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি এসব সংগঠন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া কুকি চিনের পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো মদত রয়েছে কি না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফের এ অঞ্চলের আইনশৃ্ঙ্খলা পরিস্থিতির দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করারও পরামর্শ তাদের।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর ওই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম বর্তমানে অনেকটাই সীমিত। ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মূলত দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ-বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফের সামরিক বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া উচিত বলেই মনে হচ্ছে। তিন দেশের সীমান্তের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে বান্দরবানের এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখানে ফের সেনাবাহিনীকে দায়িত্বে আনতে হবে।
এ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে বিভিন্ন বিদেশি সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নজরদারি প্রয়োজন। এ অঞ্চলের কুকি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর লোকজন মূলত খ্রিষ্টান। ভারত ও মিয়ানমারের কুকি চিন জনগোষ্ঠীও খ্রিষ্টান। এ অঞ্চলের খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম ও তাদের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
যে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এই কুকি চিনের সংশ্লিষ্টতা, তাদের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই কম। তাদের বসবাস ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন। তবে বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা কম হলেও ভারত-মিয়ানমার এমনকি চীনের অনেক স্থানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতের মনিপুরসহ মিয়ানমারের অনেক স্থানে তারা সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়।
নগদ অর্থের জন্যই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে কুকি চিন হামলা ও লুটপাট চালাচ্ছে। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পরিচালনা করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। যেহেতু তাদের কাছে আধুনিক অস্ত্র রয়েছে, তাই সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত ব্যাংকগুলো সহজ টার্গেট হিসেবে সেখানে হামলা চালিয়ে তারা টাকা লুট করেছে।
আমাদের সমতল ভূমিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের আটক করতে যতটা সহজে সফলতা লাভ করতে পারে, পাহাড়ি এলাকার ভূপ্রকৃতির বিন্যাসের কারণে সেখানে বিষয়টি এতটা সহজ নয়। কারণ সেখানে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে থাকার অনেক সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দুর্গম সীমান্তের কারণে সহজেই তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিতে পারে। এবং ওই সব সীমান্ত এলাকায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও খুব একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। কুকি চিন বা ওই এলাকায় তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এই ভৌগোলিক সুবিধাটা নিচ্ছে।
ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাগুলো জননিরাপত্তায় প্রভাব ফেলার পাশাপাশি ওই এলাকার পর্যটন খাত ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে সেখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাবে। এ ছাড়া তাদের যদি দমন করা না যায়, তারা ওই এলাকার সাধারণ জনগণের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ডাকাতি করবে। তাই কুকি চিনের এসব কর্মকাণ্ড ওই অঞ্চলের জনজীবনের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ যার সংক্ষিপ্ত নাম- কেএনএফ। দেশের পার্বত্য অঞ্চলে হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া সংগঠনটি এখন ভয়ংকররূপে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে বলেই এই ধরনের ডাকাতির সাথে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করার নীলনকশাও বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। শুরুর দিকে শান্তিপ্রিয় সংগঠন হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে বিষধর সাপের মতো ফণা তুলতে শুরু করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আঞ্চলিক এ সংগঠন। ইতোমধ্যেই কেএনএফ বানিয়েছে নিজস্ব পতাকা। তৈরি করেছে মনগড়া মানচিত্র। আর এসব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথা আলাদা রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়েছে প্রশিক্ষিত নিজস্ব ‘বাহিনী’। যাদেরকে দেওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর আদলে কমান্ডো প্রশিক্ষণ।
সরকারের উচিত হবে দেশের স্বাধিনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে দ্রুততম সময়ে এসকল সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা এবং পার্বত্য অঞ্চলে দ্রুত সেনাবাহিনীর ক্যাম্প বৃদ্ধি করা।
[ রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]