ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ ১৮:২৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৬১ বার
ঢাকা: শিশুসাহিত্যিক, আলোকচিত্রী পরিচয়ের আড়ালে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচার করতেন টিপু কিবরিয়া। এ শিশুসাহিত্যিকের বাসায় অভিযান চালিয়ে তার ডিভাইসে মিলেছে ২৫ হাজার অশ্লীল ছবি ও এক হাজার পর্নোগ্রাফি ভিডিও।
র্যাব জানায়, আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধচক্রের সঙ্গে যুক্ত এই শিশুসাহিত্যিক-আলোকচিত্রী। বিশ্বের অনেক দেশে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছেন তিনি।
শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের অভিযোগে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে টিপু কিবরিয়া ও তার সহযোগী কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের একটি টিম এ দুজনকে গ্রেপ্তার করে।
একই অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৪ সালের জুনে ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে টিপু কিবরিয়াকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তখন ওই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়। ওই মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে ৬ বছর কারাবন্দি থেকে ২০২১ সালে মুক্ত হন টিপু কিবরিয়া।
দুই বছর পর ফের একই অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন তিনি।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের বাংলাদেশ অংশের মূলহোতা টিপু কিবরিয়া। তার বাসা থেকে ক্যামেরা, পিসি, ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা ছবি ও এক হাজারের মতো ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া গেছে। শিশু পর্নোগ্রাফির জন্য ভুক্তভোগী শিশুদের সবাই ছিন্নমূল পথশিশু।
সিটিটিসির প্রধান বলেন, গুলিস্তান, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা শহরের ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ছিন্নমূল, পথশিশুদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে পর্নোগ্রাফিতে যুক্ত করতেন টিপু কিবরিয়া। শিশুদের বাসায় নিয়ে গিয়ে অশ্লীল ভিডিও বানিয়ে, গোপনাঙ্গের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন তিনি। শুধু তার বাসায় নয়; বিদেশি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মাফিক বন-জঙ্গলে পথশিশুদের নিয়ে গিয়ে পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও করতেন তিনি। তার বাসায় পর্নোগ্রাফির ভিডিও এডিটিং প্যানেলও রয়েছে। সেখানে তিনি এডিটিং করে ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে ক্লায়েন্টদের মেইলে পাঠাতেন। যা পরে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হতো।
তিনি বলেন, টিপু কিবরিয়া আগে ইমেইলের মাধ্যমে পর্নো ভিডিও-ছবি পাঠাতেন। পরে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য নতুন মেগা ও টোটেনা নামে দুটি এনক্রিপটেড অ্যাপসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে কনটেন্টগুলো পাঠাতেন। আমরা তার কাছ থেকে যে ডিভাইস উদ্ধার করেছি তাতে দেখা গেছে, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ আরও অনেক দেশের গ্রাহকদের তালিকা পাওয়া গেছে। যাদের কাছে এসব বিকৃত, অশ্লীল পর্নোগ্রাফির ভিডিও-ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন টিপু।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, টিপু কিবরিয়ার কাছ থেকে উদ্ধার সব ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ফরেনসিক করে আমরা এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার অশ্লীল ছবি ও ১ হাজার ভিডিও পেয়েছি।
ফরেনসিক বা ফিল্টারিংয়ের কাজ শেষ হলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসির প্রধান বলেন, মাত্র ৫০০, হাজার টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তিনি ছিন্নমূল ও পথশিশুদের নিয়ে আসতেন। তার চক্রে কামরুল ছাড়াও আরও অনেক সহযোগীর নাম আমরা পেয়েছি। আমরা দুজনকে গ্রেপ্তারের সময় একজন ভুক্তভোগী শিশুকে উদ্ধার করেছি। ওই সময় টিপুর বাসায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক পর্নো সিডি, লুব্রিকেটিং জেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়। পরে ওই শিশুটিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব ভিডিও-ছবির জন্য টিপু কিবরিয়া কি পরিমাণ টাকা পেতেন? কীভাবে পেতেন? জানতে চাইলে ডিএমপির এ এ কর্মকর্তা বলেন, অর্থের লেনদেন হতো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন এবং কিছু এমএফএসের মাধ্যমে। ৩/৪টি ছোট ছোট ভিডিও পাঠালেই তিনি পেতেন হাজার ডলার। সর্বশেষ এক বিদেশি গ্রাহককে তিনি ৩টি পর্নোগ্রাফিরি ভিডিও পাঠিয়ে এক হাজার ডলার পেয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে টিপু কিবরিয়ার এজেন্ট রয়েছে। আমরা বেশ কয়েকজন এজেন্টকে শনাক্ত করেছি। পাশাপাশি ২৫/৩০ জনের মতো ভুক্তভোগী শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা সবাই ছেলে শিশু। তবে সংখ্যা অনেক।
এদিকে সিটিটিসি জানায়, ২০০৫ সালের দিকে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন টিপু কিবরিয়া। ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, টিপু টাকার বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অন্তত আট আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের কাছে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও ও স্থিরচিত্র পাচার করে আসছিলেন।
ওই সময় ইন্টারপোলের বরাত দিয়ে সিআইডি জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্নো ব্যবসায়ীচক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত টিপু কিবরিয়া। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশু পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচার হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগটির বিষয়ে নজরদারি করে টিপুর চেহারা শনাক্ত করে ইন্টারপোল।
প্রসঙ্গত, শিশুসাহিত্যিক টিপু কিবরিয়ার আসল নাম টিআই এম ফখরুজ্জামান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করে কিশোর কবিতা, গল্প ও ছড়া লিখতেন টিপু। এক সময় সেবা প্রকাশনী পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কামিয়েছেন নাম-যশ-খ্যাতি। বেশ কয়েকটি ছড়াবই ছাড়াও ‘হরর ক্লাব’ নামে শিশুদের জন্য সিরিজ বই লিখেছেন তিনি। ‘একশো এক’ নামক একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি সাহিত্য চর্চার আড়ালে পুনরায় শিশু পর্নোগ্রাফির তৈরির অপকর্ম শুরু করেন।