ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৬ জুন, ২০২৪ ১০:৪০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১১৪ বার
বরিশাল: সদ্য সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান, যাকে গ্রামের বাড়ির মানুষ ‘পিন্টু’ নামেই চেনেন। সম্পদের পাহাড় ও দ্বিতীয় স্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদীর বাহাদুরপুর গ্রামের মানুষ অনেকটাই হতবাক।
জানা গেছে, নিজ এলাকায় তেমন পদচারণা না থাকলেও সেখানে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন তিনি, সেইসাথে ছিলেন সন্মানিত ব্যক্তিও।
নিজের নামে গ্রামের বাড়িতে সেইভাবে বিশাল সম্পদের পাহাড় না থাকলেও স্বজনদের রয়েছে অঢেল সম্পদ। আবার সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সহযোগীতায় নিজ গ্রামের বাড়ি ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করেছেন তিনি।
স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবারের অন্য সবার ভাগ্য খুলেছে মতিউর রহমান ওরফে পিন্টুর হাত ধরেই। তিনি রাজস্ব কর্মকর্তা হওয়ার পর ফুলে ফেঁপে উঠেছে সবার কপাল।
জানা গেছে, স্কুলজীবন থেকেই তুখোড় মেধাবী ছিলেন মতিউর। তিনি মুলাদীর পাশের উপজেলা বাবুগঞ্জে খালার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। পরিবারে ৩ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। আর মতিউরের বাবা আব্দুল হাকিম হাওলাদার পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তাকে সবাই সৎ ব্যক্তি হিসাবেও চিনতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মতিউর রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত হাকিম হাওলাদারের পরিবারে তেমন সচ্ছলতা ছিল না। গ্রামে জায়গা-জমির পরিমাণও খুব বেশি ছিল না। তবে ৯১ পরবর্তী বিএনপির শাসনামলে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে মতিউরের উত্থানের পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে এই পরিবারের অর্থবিত্তের চিত্র। এ সময় বিত্তশালী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন তার মেজো ভাই কাইয়ুম হাওলাদার।
ভাইয়ের মতো কাইয়ুমও এরই মধ্যে বনে গেছেন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। মুলাদী পৌর শহরে থানার উত্তর পাশে তার বিশাল আলিশান বাড়ি রয়েছে। যদিও সেই বাড়িটি নাম মাত্র দামে কয়েকবছর আগে কিনেছেন কাইয়ুম। স্থানীয়দের দাবি, ভাই মতিউরের কারণেই রাজধানী ঢাকার টঙ্গী এলাকায় ট্রাভেল ব্যাগ তৈরির কারখানা করেন কাইয়ুম। এছাড়া এই পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে অনেক জমিও রয়েছে। যেসকল সম্পদের ব্যবহার মতিউরের স্বজনরা করলেও প্রকৃত মালিক কে তা নিশ্চিত নন কেউ।
মতিউরের বাবা শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসরের পর ২০০৩ সালে কাজিরচর ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। জীবদ্দশায় তিনি কাজিরচর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন। তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমানে মুলাদী উপজেলা ১৪ দলের সমন্বয়ক ইউসুফ আলীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আবার ওয়ান-ইলেভেনের সময় চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ শেষ হলেও নানা উপায়ে আরো প্রায় চার বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকেন হাকিম।
বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা কালাম জানান, বাবাকে চেয়ারম্যান বানাতে প্রচুর টাকা খরচ করেছিলেন মতিউর। কারণ মতিউর ছাড়া তখন অন্য ভাইয়েরা স্বাবলম্বী ছিলেন না।
আর ওই নির্বাচনের মাধ্যমে মতিউর নিজের অবস্থার জানান দিলেও তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা এলাকায় কেউই জানতো না বলে জানিয়েছেন বাহাদুরপুর গ্রামের অন্য বাসিন্দারা। তাদের মতে, মতিউর সরকারি বড় কর্মকর্তা হওয়ায় ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি আছে এটাই সবাই ভাবতো। তবে এত সম্পদের ফিরিস্তি কেউ ভাবতেও পারেনি।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মুলাদীর এক জনপ্রতিনিধি বলেন, বিএনপি শাসনামলের এক মন্ত্রীর পরিবারের ঘনিষ্টজন ছিলেন মতিউর। আর রাজস্ব ক্যাডারে যাওয়ার আগে ১১তম বিসিএসে ট্রেড ক্যাডারে চাকরি হয়েছিল তার। ট্রেড ক্যাডার বিলুপ্ত হলে পছন্দ অনুযায়ী অন্যান্য ক্যাডারে যাওয়ার সুযোগ পান ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আর রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে মতিউরের যোগদানের পর এই পরিবারকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, মতিউরের যেসব অবৈধ সম্পদের খবর সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তার সঙ্গে তুলনা করলে গ্রামের বাড়িতে তেমন কিছুই করেননি তিনি। তবে তারপরও যতটুকু যা আছে তাও বিস্ময়কর।
গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাতায়াত না থাকলেও বাবার পুরোনো ঘরের জায়গায় দৃষ্টিনন্দন আলিশান বাড়িসহ আশপাশে দৃষ্টিনন্দন নানান স্থাপনা রয়েছে সদ্য সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তার পরিবারের।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন মতিউর অর্থাৎ পিন্টুর চাচাতো ভাই মাহমুদুন্নবী। তার মতে, সব কিছুই ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, মানুষ মানুষের ভালো সহ্য করতে পারে না। ঈর্ষান্বিত হয়ে শত্রুতা করে। সে জন্যই আজ মতিউর রহমানের মতো একজন ভালো মানুষকে নিয়ে এত টানাহেঁচড়া চলছে।
মতিউর স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান দাবি করে মাহমুদুন্নবী বলেন, মতিউরের দাদা হাজি আফাজ উদ্দীন হাওলাদার ব্রিটিশ আমলে জাহাজে করে হজ করতে গিয়েছিলেন। বাবা হাকিম হাওলাদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পরে কাজিরচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, সদ্য আলোচনায় আসার আগে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রচণ্ড ক্ষমতার দাপট ছিল এলাকায়। দাপটের আমলেই সরকারি নানান দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে নিজ বাড়ির আশপাশের এলাকার চিত্র পাল্টেছেন। যেখানে তার বাড়ির সামনে খালের ওপরে পাকা সেতু। বাড়িতে ঢুকতে একপাশে তিনতলা মাদ্রাসা, আরেক পাশে দোতলা মসজিদ। মাদ্রাসা আর মসজিদের মাঝখানে গেট। সেই গেট পার হয়ে ভেতরে পিন্টুর দোতলা বাড়ি। যদিও বর্তমানে সেই বাড়ির কলাপসিবল গেটে ঝুলছে তালা।
এ বিষয়ে পিন্টুর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ হাওলাদার জানান, ২০১৮ সালে মতিউর রহমানের বাবা আবদুল হাকিম হাওলাদারের মৃত্যুর খবরে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। পরের বছর মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়িতে আসেন। বাড়িতে তার ছোট ভাই নুরুল হুদা ও মেজ ভাই কাইয়ুম হাওলাদার মাঝেমধ্যে আসেন।
তিনি জানান, নুরুল হুদা ঈদের এক দিন আগে এসে কোরবানি দিয়েছেন। তারপর গত শুক্রবার ঢাকায় চলে গেছেন। মুলাদী পৌর এলাকার থানার পাশে মেজ ভাই কাইয়ুম হাওলাদারের দোতলা বাড়ি আছে, মাঝেমধ্যে তিনি সেখানে এসে থাকেন।
অপরদিকে পিন্টুর বাড়ির সামনে দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া খালের দুই পাড় সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা, দুই পাশেই রয়েছে পাকা সড়ক। খালের দুই পাড়ের প্রতিটি বাড়ির সামনে সান বাঁধানো ঘাট করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খালটিতে বেশ কয়েকটি পাকা সেতু নির্মাণ করেও দেওয়া হয়েছে।
পিন্টুর বাড়ির দক্ষিণ দিকে রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার পাশেই তিনতলা একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্লিনিকের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে হাওলাদার ফাউন্ডেশন নামের একটি তহবিল। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও পরিচালনা হচ্ছে। তবে এ ফাউন্ডেশনের সাথে কারা জড়িত কিংবা অর্থের উৎসের বিষয়েও তেমন কোনো তথ্য জানাতে পারেননি কেউ।
যদিও হাওলাদার ফাউন্ডেশনের তহবিলের উৎস কী—এমন প্রশ্নের জবাবে ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও মতিউরের চাচাতো আরেক ভাই মো. ফকরুদ্দিন জানান, এলাকার মানুষের অনুদান থেকে তহবিল আসে।
এলাকার মানুষের অর্থে কি এত কিছু করা সম্ভব—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, দেশের বিত্তশালী ব্যক্তিরাও সহায়তা করেছেন। তবে কী কারণে বিত্তশালীরা সহায়তা করেছেন, তা তিনি জানেন না।
আবার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ করার সময় খাল ভরাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ বিষয়ে কাজিরচরের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস বলেন, প্রতিষ্ঠানটি গড়ার সময় এলাকার কৃষকেরা প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি।
এদিকে ওই বিদ্যালয়ের পাশে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে, যা অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় বলে জানালেন স্থানীয়রা। বাহাদুরপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেন, জোয়ার-ভাটার খাল আটকে দেওয়ায় শুকনো মৌসুমে ফসলী জমিতে সেচ দিতে দুর্ভোগে পড়েন কৃষকরা। সেটি লাঘব হলে হয়তো আশ্রয়কেন্দ্রের থেকে বেশি সুবিধা হতো।