ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

অচল ডেমু ট্রেনে খরচ সাড়ে ৫ কোটি

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১১ জুলাই, ২০২৪ ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১০০ বার


অচল ডেমু ট্রেনে খরচ সাড়ে ৫ কোটি

ঢাকা: রেলের স্বল্প দূরত্বে যাত্রীদের উচ্চমানের সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ৬৫৪ কোটি টাকায় ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনেছিল সরকার। ২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ট্রেনগুলো ২৫-৩০ বছর সচল থাকবে এমন নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু চালুর পর ৫ বছরও ঠিকঠাক না চলায় ২০১৯ সাল থেকে ডেমু ট্রেনে যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

 

ডেমু ট্রেন চলাচল বন্ধ। কিন্তু তারপরও এসবের মেরামত বাবদ ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪০ টাকা খরচ করে ফেলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ডেমুর জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ ক্রয় বাবদ সরকারের ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টাকা অপচয় করা হয়েছে।

এ দুই অর্থ বছরে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা অপচয় করেছে রেলওয়ের দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলি কার্যালয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে (অডিট রিপোর্ট) উঠে এসেছে এমন তথ্য।

রেলওয়ের নিরীক্ষায় দায়ী করা হয়েছে চট্টগ্রামের পাহাড়তলি কার্যালয়ের কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল) ও পার্বতীপুর কার্যালয়ের কর্মব্যবস্থাপকে (ডিজেল)। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে কার্যালয়ের সংরক্ষিত চুক্তিপত্র, বিল, আউটটার্ন ও ট্রেন চলাচল সংক্রান্ত রেকর্ড যাচাই করে অডিট রিপোর্টে এমন তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে।

রেলসুত্র জানিয়েছে, ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের লোকোশেডে এখন সাতটি ডেমু পড়ে আছে। ১২টি ডেমু চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট শেডে পড়ে আছে। একটি মাত্র ডেমু চট্টগ্রাম দোহাজারী রুটে চলছে। তবে সেটিও অনিয়মিত।

রেলওয়ের ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কস ম্যানুয়াল, মেকানিক্যাল কোড অনুযায়ী প্রতিটি লোকোমোটিভের (রেল ইঞ্জিন) স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর। যেকোনো ইঞ্জিন বা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের করে কার্যোপযোগী রাখার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিডিউল মেরামত করা হয়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জানা যায়, মেয়াদ ফুরানোর আগে অচল ডেমু সারাই করতে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন পার্বতীপুর ও পাহাড়তলির কর্মকর্তারা।

২০১৩ সালে দেশে আসা লোকোমোটিভগুলা সারাই করতে ২০২০ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সামসুদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের সঙ্গে চুক্তি করে পার্বতীপুর কার্যালয়। পঞ্চগড়-পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটে চলাচলকারী ডেমু ট্রেন মেরামত করতে সামসুদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসকে ৮ লাখ ৯ হাজার ৩১০ টাকা পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে পাঁচটি ডেমু ট্রেন মেরামতে ২ কোটি ৯০ লাখ ২৩ হাজার ৭৩০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পার্বতীপুর ও পাহাড়তলি কার্যালয়ে ডেমু ট্রেন সারাই করতে ২ কোটি ৯৮ হাজার ৩৩ হাজার ৪০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (সিআইডিএ) ম্যানুয়াল অনুযায়ী প্রতিটি ইঞ্জিন এক বছর ৬ মাস অন্তর এফ-শিডিউল এবং ৩ বছর অন্তর জি-শিডিউল সম্পন্ন করার নির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ দামি পার্টস পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০ বছরের আয়ুষ্কাল সম্পন্ন ডেমু ট্রেন ক্রয়ের ৭ বছরের মধ্যে প্রতিটি ইঞ্জিন মেরামতের নামে ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ পার্টস পরিবর্তন করা হয়েছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। তারপরও ডেমু ট্রেন বন্ধ থাক সত্ত্বেও এর মেরামত বাবদ অর্থ পরিশোধ দেখানো হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জানা যায়, দুই সেট ডেমু ট্রেন বন্ধকালীন সময়ে ১ হাজার ৭১২ লিটার জ্বালানি তেল ও ৩২২ লিটার লুবঅয়েল ইস্যু করা হয়েছে যার মূল্য ২ লাখ ৭৫ টাকা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ডেমু ট্রেন দুটির বিপরীতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৭ জুন পাহাড়তলির ডিসিওএসের মাধ্যমে (পরিদর্শন) পার্বতীপুরের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ কিনেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দুই সেট অচল ডেমুর জন্য ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়।

নিরীক্ষার ব্যাখ্যায় পার্বতীপুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, কী পরিমাণ তেল ডেমু মেরামতে ব্যবহৃত হয়েছে ও কী পরিমাণ তেল মজুদ রয়েছে। কিন্তু যন্ত্রাংশ কেনার বিষয়ে কোনো তথ্য তারা দেননি।

ডেমুর যন্ত্রাংশ ক্রয়ের দুর্নীতি এখানেই শেষ নয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে ৫৬টি চুক্তির মাধ্যমে ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৭ হাজার ৪০৩ টাকার অনিয়মিতভাবে ডিজেল ও ডেমু যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন না থাকলেও উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি প্রয়োগ না করে সীমিত দরপত্র পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রেলওয়েতে প্রাতিষ্ঠানিক আপাদমস্তক দুর্নীতি হয়ে থাকে। ডেমু ট্রেনের পুরো অর্থটাই জলে ডুবেছে। সেটার দায় রেল কর্তৃপক্ষ নেয়নি। এসব জনগণের টাকা।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা-পিপিআরের বাইরে গিয়ে কেনাকাটার আসলে সুযোগ নেই। ডেমু ট্রেনে কেনাকাটা বিষয়ক যে দুর্নীতি হয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।

এদিকে রেলের ডেমু মেরামতে জড়িত রোলিং স্টোক বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মহাপরিচালক পার্থ সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ডেমুতে নতুন কোনো বরাদ্দ নেই। এসব আগের বরাদ্দ।  

এ সময় এই প্রতিবেদক অডিট আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা গণমাধ্যমকে জবাব দেওয়ার বিষয় না, অডিট বিভাগকে জানানো হবে।

এ বিষয়ে রেলের বর্তমান সচিব হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, তার সময়ে কোনো চিঠি তিনি পাননি। তাই এই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। যদি তাকে নিরীক্ষার বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয় তবে তিনি চিঠির জবাব দেবেন।  

প্রতিবেদনে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের পার্বতীপুর ও পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। রেলওয়ের মহাপরিচালক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে আধা-সরকারি চিঠি দেওয়া হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে তেমন বড় কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। নিরীক্ষা অধিদপ্তর রেলওয়ে সচিবকে চিঠি দিলেও তার জবাব দেওয়া হয়নি। চিঠি দেওয়া হয়েছিল ২০২১ সালের আগস্ট মাসে রেলের তৎকালীন সচিব মো. সেলিম রেজাকে। তিনি ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেলওয়েতে ছিলেন। এরপর হুমায়ুন কবীর সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন।


   আরও সংবাদ